দিনে গ্যাস থাকে না বলে অনেকে গভীর রাতে কিংবা খুব ভোরে উঠে রান্না করছেন। অনেকে বাধ্য হচ্ছেন এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে।
Published : 06 Oct 2022, 01:39 AM
ঢাকার ফার্মগেইট এলাকার বাসিন্দা আনু সারাদিন অন্যের বাড়ি ঘুরে ঘুরে রান্নার কাজ করেন। বিকালে বাসায় ফিরে যখন নিজের পরিবারের খাবার জোগাতে বারোয়ারি রান্নাঘরের চুলায় হাঁড়ি চড়ান, তখন গ্যাসের অভাবে চুলা আর জ্বলতেই চায় না।
শীত এখনও আসেনি, কিন্তু এরই মধ্যে গ্যাস সংকটে নাকাল হতে হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের। আনু জানালেন, তার বাসার চুলায় গ্যাসের জোর বাড়ে রাত ১০টার পর, যখন সবার রান্না-খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
“আমার সকাল তো শুরু হয় সকাল ৬টায়, সারাদিন মাইনষের বাসায় কাজ-কাম করি। বাসায় ফিরতে ফিরতে ধরেন ৪টা-৫ টা। আগে যেইটা করতাম, বাসায় ফিরাই তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের রান্না শেষ করতাম। তারপর আর চিন্তা থাকতো না, বিশ্রাম নিতাম। কিন্তু এখন বইসা থাকা লাগে, কখন গ্যাস বাড়বে আর কখন সিরিয়াল পাব।”
দিনের বড় একটি অংশ চুলায় গ্যাস না থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার অধিকাংশ এলাকা থেকেই। অনেকে গভীর রাতে কিংবা খুব ভোরে উঠে রান্না করছেন। গ্যাস লাইন থাকার পরও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার কিনতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে।
কিন্তু আনুর মত যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, আলাদা করে এলপিজি সিলিন্ডার কেনা বা হোটেল থেকে খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। ফলে ‘লাইনের গ্যাসই’ তাদের একমাত্র ভরসা।
পেট্রোবাংলার কাছ থেকে নিয়ে সারা দেশে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করে ছয়টি বিতরণ সংস্থা। এর মধ্যে সরকারি কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় সরবরাহ করে।
তিতাসের কর্মকর্তারা জানালেন, শীতকালে গৃহস্থলীতে গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে যায় এবং তাপমাত্রা নেমে গেলে প্রাকৃতিক কারণেও গ্যাসের চাপ কমে যায়। ফলে ওই সময়টায় প্রতি বছরই ঢাকার কিছু এলাকার মানুষকে ভুগতে হয়। কিন্তু এখন যে সমস্যাটা হচ্ছে, সেটা সরবরাহ কম পাওয়ার কারণে।
ঢাকায় প্রতিদিন ১৮০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাসের চাহিদা থাকে। সে জায়গায় দৈনিক গড়ে ১৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস (এমএমসিএফডি) পাওয়া যাচ্ছে বলে জানালেন টিজিটিডিসিএলের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মোহাম্মাদ সেলিম মিয়া।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সাপ্লাইটা এখন একটু কম আছে আগের তুলনায়। এইটাই মূল কারণ। আর এই গ্যাস সংকট আবাসিক এলাকার সব জায়গায় না, দুই একটা পকেটে এই ক্রাইসিস হচ্ছে।”
চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা না গেলেও পরিস্থিতি এখনো পর্যন্ত ‘সহনীয় অবস্থায়’ আছে বলে মনে করছেন তিতাসের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেলেন, “আমার বাসায়ও কিছুটা কম। পিক আওয়ারে কিছুটা কম থাকে। কিছুটা কম, সেইজন্যই এই সমস্যাটা হচ্ছে।”
সেলিম মিয়া ‘দুই একটা পকেটে’ গ্যাস সঙ্কট হওয়ার কথা বললেও খোঁজ খবর নিয়ে ঢাকার উত্তরা, খিলক্ষেত, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কল্যাণপুর, খিলগাঁও, বনশ্রী, কাঁঠালবাগান, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা থেকেও গ্যাস সঙ্কটের অভিযোগ পাওয়া গেল।
তাদের ভাষ্য, সকালে সূর্য ওঠার পর চুলা আর জ্বলতে চায় না। আগুন যদি জ্বলেও, গ্যাসের চাপ কম থাকায় তার দশা হয় নিভু নিভু, ওই আগুনে আর যাই হোক, রান্নার কাজ হয় না। গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হতে হতে মাঝরাত হয়ে যায়।
এ পরিস্থিতিতে চাকরিজীবীদের ভোগান্তিটা আরও বেশি। তেমনই এক ভুক্তভোগী খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা সাজিয়া আফরিন।
তিনি এবং তার স্বামী দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সময়মত গ্যাস না পাওয়ায় গত কয়েকদিন ধরে তাদের টানা বাইরের খাবার খেতে হচ্ছে। তাতে এক দিনে বাড়তি খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে রোজ বাইরের খাবার খেতে খেতে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বেড়ে গেছে।
সাজিয়া বলেন, “আমার বাসায় গ্যাস চলে যায় সকাল ৮টার মধ্যে। আসে বিকালের পর। ভোরে ভোরে ঘুম থেকে যদি উঠতে পারি, তাহলে রান্না করতে পারি। কিন্তু যেদিন ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে যায়, সেদিন ঝামেলা হয়ে যায়।”
এরকম পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার কিনে নিয়েছেন মেরাদিয়ার বাসিন্দা পলি ইসলাম। তাকে সিলিন্ডারের বাড়তি খরচের পাশাপাশি তিতাসের লাইনের জন্যও আগের মত টাকা দিতে হচ্ছে মাসে মাসে, সেটা গ্যাস না পেলেও।
পলি বললেন, “এটা ছাড়া উপায় নাই আসলে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বাবুদের নিয়ে স্কুলে যেতে হয় আমার। ওদের খাবার রেডি করতে হয়। লাইনের গ্যাসের আশায় বসে থাকলে তো আমার বাচ্চারা না খেয়ে থাকবে।”
যাদের রোজ বাইরের খাবার কিনে খাওয়ার কিংবা এলপিজি সিলিন্ডার কেনার সুযোগ বা সামর্থ্য নেই, তারা আছেন আরও বিপাকে।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইফফাত আরা মামুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটা বেসরকারি হোস্টেলে থাকছেন। সেখানেও ভোরবেলা গ্যাস যায়, আর ফেরে সন্ধ্যার আগে। ফলে রেস্তোরাঁ থেকে কিনে কিংবা প্যাকেটজাত শুকনো খাবার খেয়ে থাকতে হচ্ছে, কিন্তু সেজন্য বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে।
“আমরা মেয়েরা মিলে যে সিলিন্ডার গ্যাস কিনব, সেটা তো আন্টি (হোস্টেল মালিক) দেবে না। রাইস কুকার বা ইনডাকশন চুলা কেনার কথাও বলছিলাম। সোজা নিষেধ করছে, ওতে তার বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে।”
ইফফাত জানালেন, কেবল তার হোস্টেলে না, উত্তরায় তার ভাইয়ের বাসাতেও গ্যাস নিয়ে একই সমস্যা।
বাসাবাড়িতে এই গ্যাস সঙ্কটের সমাধান কবে নাগাদ হতে পারে জানতে চাইলে টিজিটিডিসিএলের কর্মকর্তা সেলিম মিয়া বললেন, “আপনারা তো শুনছেন, এলএনজি কিছুটা কমছে। এলএনজি আগে যেটা ছিল, এখন একটু কমিয়ে এনেছে।”
তাছাড়া চাহিদার ওপরও পরিস্থিতি অনেকটা নির্ভর করে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে বিদ্যুতের ডিমান্ডটা একটু বেশি। পূজা গেল। পূজার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনটা বেশি করতে হয়েছে। আবার কিছুদিন পর দেখবেন যে শীত নেমে যাবে, তখন বিদ্যুতের উৎপাদন কমে যাবে। তখন গ্যাস সরবরাহ যেটা আমাদের থাকে, সেটাই দিতে হবে।”
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ আছে ১০ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট৷ আর সারা দেশে প্রতিদিনের চাহিদা থাকে ৩৮০ কোটি ঘনফুটের মত৷ সেখানে ২৮০ কোটি ঘনফুটের মত সরবরাহ করতে পারে বিতরণ সংস্থাগুলো।
এর মধ্যে গৃহস্থালির রান্নার কাজে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ আছে ৪০ কোটি ঘনফুটের মত, যা মোট সরবরাহের ১৪ শতাংশের সামান্য বেশি। আর সবচেয়ে বেশি, ৩৮ শতাংশ গ্যাস পায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো, সেটাও চাহিদার তুলনায় কম।
দৈনিক সরবরাহ করা গ্যাসের মধ্যে ২৩০ কোটি ঘনফুটের মত আসে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে; বাকিটা পূরণ হয় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে।
তবে সেলিম মিয়া আশাবাদী, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আসতে শুরু হলে গ্যাসের ওপর চাপ কমে আসবে।
“কিছু দিন পর কিছু বিদ্যুৎ গ্রিডে আসবে অন্য সোর্স থেকে, কয়লা থেকে কিছু বিদ্যুৎ আসবে। সম্ভবত ইন্ডিয়া থেকেও কিছু আসবে। সেগুলা পেলে আমার মনে হয় গ্যাসের যে সাপ্লাই আছে, সেই সাপ্লাই দিয়ে আমাদের চলবে। বিদ্যুতে আর এত গ্যাস লাগবে না। তখন বিদ্যুতের সেই গ্যাসটা আমরা ইন্ডাস্ট্রিকে দিতে পারব।”