শরীরে কুলায় না, তবু তাদের দাঁড়াতে হয় ওএমএসের লাইনে

ওএমএসের দীর্ঘ লাইনে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন বয়স্করা। শীত কমে রোদের তীব্রতা বাড়ায় কষ্টও বেড়েছে।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2023, 01:40 PM
Updated : 13 Feb 2023, 01:40 PM

“জামাই নাই- কে নিব, বয়স হইয়া গেছে ৬০। মাজায় ব্যথা, হার্টের রোগী। ঠেলাঠেলির মধ্যে ঢুকতে পারি না, বইসা থাকি, ভিড় কমলে যদি কিছু থাকে নিমু।”

সোমবার রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় ওএমএসের ট্রাকের লাইনে না দাঁড়ানোর কারণ বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব সুফিয়া বানু। চাল আর আটা কেনার আশায় ব্যাগ হাতে তিনি ট্রাকের অদূরে রাস্তার ধারে বসে ছিলেন।

কথায় কথায় জানালেন, ঘরে দুই মেয়ে আর এক ছেলে আছে। ছেলেটা ছোট, স্কুলে যায়, কাজে লাগেনি এখনও। স্বামী গত হয়েছেন আগেই।

খাদ্যপণ্য কিনতে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ঝক্কি পোহানোর মত শরীরের অবস্থা নেই বলে জানালেন এই অসহায় নারী।

একই সমস্যার কথা জানালেন পাশে বসে থাকা সাহাদুল হক। নোয়াখালীর এই ব্যক্তি ৪৫ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন। তিনি ফেরি করে বিক্রি করেন ভাত।

সাহাদুল বললেন, “সপ্তাহে দুইদিন এখানে চাল নিতে আসি। আমার শ্বাসের ব্যারাম, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইলে মাথা ঘুরায়, এইজন্য এখানে এসে বসছি।”

খোলা বাজারে (ওএমএস) স্বল্পমূল্যে চাল-আটা বিক্রির সরকারি যে কর্মসূচি আছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সেই কর্মসূচিতে কিউ বেড়েই চলেছে বলে জানালেন শাহানা, আরিফ, রবিউল, তাসলিমারা। বেশ কয়েক মাস ধরে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি এই লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও।

শেওড়াপাড়ায় ওএমএসের ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ফাহিম খান। বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের একসময়ের এই শিক্ষক সেখানে দাঁড়িয়েছেন সকাল পৌনে ৯টায়, বেলা ১১টার সময়ও তিনি ট্রাক ছুঁতে পারেননি।

অসহায় কণ্ঠে ফাহিম খান বললেন, “আমার ফ্যামিলিতে ১৫ জন মানুষ। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমার পক্ষে নিয়মিত বাজার থেকে কিনে সংসার চালানো সম্ভব না।

“লাইনে দাঁড়িয়ে যা পাই তা যে যথেষ্ট- তাও না, কিন্তু খরচ কিছুটা কমে। সমস্যা হচ্ছে, অনেক মানুষেরই আমার মত দরকার, তাও যদি পাওয়া যায়, তাহলে ভালো।”

টিসিবির ওই ট্রাকের দায়িত্বে থাকা ঢাকা রেশনিংয়ের তদারক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বললেন, “আজকে এখানে উপকারভোগী ৪০০ জন। চাল বরাদ্দ আছে ২ টন আর আটা ১ টন। চাল প্রতি কেজি ৩০ টাকা, আটা ২৪ টাকা, ২ কেজি ৫৫ টাকা। এখানে একজন সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজির দুই প্যাকেট মানে চার কেজি আটা পাচ্ছে।

“সকাল ৯টা থেকে আমরা দেওয়া শুরু করেছি৷ ৫টা পর্যন্ত চলার কথা, কিন্তু ৩টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে; কিছুই থাকবে না। মানুষ তো অনেক। চাল হয়ত লাইনের সবাই পাবে, আটা সবাই নাও পেতে পারে, আটার বরাদ্দ কম।”

ওএমএসের দীর্ঘ লাইনে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন বয়স্করা। শ্রমজীবী এসব মানুষের বেশিরভাগই শারীরিক নানা জটিলতার ভোগার কথা জানালেন।

আঙ্গুরী বেগম নামে এক নারীর কথায়, “যাদের শক্তি-সামর্থ্য বেশি তারা লাইন মানে না, ঠেলে সামনে চলে যায়। আমি সকাল সাড়ে ৭টায় আসছি। আমার হাই প্রেশার। এখনও পাই নাই। লাইন থেকে ঠেলে বের করে দেয়।”

কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া সবখানেই দীর্ঘ লাইন জানিয়ে তবারুন নিছা নামের আরেকজন বললেন, “কোথাও লাইনে দাঁড়াতে পারি না। মাজায় ব্যথা, ভয়ে দাঁড়াইতে পারি না। আবার মাজা নিয়ে বিছানায় পড়লে ওষুধ দেবে কে?”

শীত কমে রোদের তীব্রতা বাড়ায় কষ্টও বেড়েছে বলে জানালেন অনেকে।

সিরাজগঞ্জের মিলি আক্তার স্বামীর সাথে থাকেন মিরপুরে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে লাইন দাঁড়িয়ে তার ব্যাগে চাল-আটা মিলেছে সাড়ে ১১টায়। ততোক্ষণে মাথা ঘুরে পড়ার উপক্রম। পাশের দোকানে বসিয়ে তাকে পানি খাওয়ালেন আরেক নারী।

কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মিলি বললেন, “মানসম্মান হানি কইরা আসি তো পেটের দায়ে, কালকে এসে ফিরে গেছি। লাইনে এমন চাপ দিছে- আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।”

তদারক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বললেন, “নারীদের লাইনে বেশি সমস্যা হয়। তারা অনেকেই মনে করেন তারা পাবেন না, যেভাবেই হোক সামনে থাকতে হবে। এজন্য ঠেলাঠেলি হয়। লাইন ধরে সুন্দর করে দাঁড়ালে কিন্তু সবাই আরও আগে মালামাল নিয়ে বাসায় চলে যেতে পারে।”

ওএমএসের ট্রাক সকাল ৯টার দিকে চাল-আটা বিক্রি করতে আসে। উপকারভোগীরা বললেন, আরও আগে চাল-আটা দেওয়া শুরু করলে তাদের জন্য সুবিধা হয়।

শাহানা আক্তার নামে এক নারী বলেন, “যা দেবার কথা তাই দেয়, এ নিয়ে অসুবিধা নাই। তবে আরও আগে দেওয়া শুরু করলে ভালো হতো। তাহলে এত ভিড় হয় না।

“যার আসলেই দরকার, সে আসবে, লাইনে দাঁড়াবে। আর ৯টার পর আমাদের কাজে যাওয়া লাগে, ঘরের কাজ থাকে। লাইনে দাঁড়ালে কাজ মিস হয়।”

সোমবার ৭০টি ট্রাক, ওএমএসভুক্ত ১৪৬টি দোকান এবং সচিবালয় এলাকাসহ আরও চারটি স্থানে চাল-আটা বিক্রি করা হয়। দোকানগুলোতে ৪০৯ টন চাল ও ২৯২ টন আটা বিক্রি হয়; আর ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে বিক্রি হয় ১৪০ টন চাল ও ৭০ টন আটা।

ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষের চাহিদা আছে বলেই ভিড় বেশি। আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত তদারক করছে। ”

ট্রাকে বিক্রি আরও আগে শুরু করা যায় কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এখানে সমস্যা আছে। দোকানে হয়ত আগে দেওয়া যাবে। কিন্তু ট্রাকগুলো যেদিন বিক্রি করবে, সেদিনই স্পটে যায়। ফলে খুব আগে শুরুর সুযোগ নেই।”