শনি ও রোববার কমবে আশায় দাম যাচাইয়ে সময় পার করছেন ক্রেতাদের বড় অংশ।
Published : 15 Jun 2024, 12:15 AM
পূর্বাচল ৩০০ ফিট মার্কেটে গরু নিয়ে আসা মিন্টু মন্ডল মাঝারি আকারের একটি গরুর দাম চাইছিলেন এক লাখ ৭০ হাজার টাকা।
মিন্টুর পাশেই ছিলেন আরেক ব্যাপারি সফিকুর রহমান। এক লাখ ৭০ না চেয়ে, এক লাখ ৯০ হাজার টাকা দাম চাওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি।
মিন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “এক লাখ ৭০ চেয়েও কাস্টমার মিলাতি পাচ্ছি না। আর উনি দাম আরও বাড়াতি বলে। তার কথা শুনলি পরে তো আমার আর বেচাবিক্রিই করা লাগবি নানে।”
রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে শুক্রবার পর্যন্ত বেচাকেনা জমেনি খুব একটা। এর একটি কারণ সফিকুরের মতো বিক্রেতারা। তারা গতবারের তুলনায় অনেক বেশি দাম চাইছেন। ক্রেতারা কম দাম বলার পর তারা চাওয়া দাম থেকে খুব বেশি কমাতে রাজিও হচ্ছেন না।
অন্যদিকে ক্রেতারও এই বাড়তি দামে কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কম। তারা ভাবছেন, গত কয়েক বছরের মতোই শেষ সময়ে দাম কমবে। তাই ঘুরে ঘুরে দাম যাচাইয়েই ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেল বেশিরভাগ মানুষকে।
শুক্রবার রাজধানীর খিলক্ষেত ৩০০ ফিট রোড গরুর হাট ও পূর্বাচলের নীলা মার্কেট হাট ঘুরে এই চিত্র দেখা যায়।
বিক্রেতারা বলছেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় বেশি দাম দিতে হবে। ক্রেতারা বলছেন, বিক্রেতারা প্রতি বছরই এসব কথা বলেন। ঈদের আগে আগে পরে তারা দাম ছাড়েন। শনি ও রোববারই আসলে দাম বোঝা যাবে।
নীলা মার্কেট হাটে গরুর দাম জিজ্ঞেস করে করে সামনের দিকে আগাচ্ছিলেন আনোয়ার হোসেন। দুই ছেলে রাকিব হাসান ও রাগিব হাসান তার সঙ্গে। একটি পিকাপ ভ্যানের সঙ্গে কথাও বলে রেখেছেন, গরু কেনা হলে নিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু আধা ঘণ্টা ঘুরেও বাজেট অনুযায়ী গরু পাচ্ছিলেন না৷
আনোয়ার বলেন, “গরুর দাম বেশি। গত বছরও যে টাকায় যে সাইজের গরু কিনতে পেরেছি, এবার তেমন দামে একই সাইজের গরু কিনতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।”
দুপুরে খিলক্ষেত থেকে ৩০০ ফিট হাটে যান এ আর হুমায়ুন কবির, সঙ্গে পরিবারের আরও তিন জন। তার অভিজ্ঞতাও আনোয়ারের মতই।
হুমায়ুন বলেন, “বাচ্চা গুরুর দাম চায় এক লাখ ২০ হাজার। কেমনে কিনব বলেন? ব্যাপারীরা মানুষদের সঙ্গে যা করছে, এটা ঠিক না। আজাইরা দাম বাড়াইয়া চায়। এভাবে দ্বিগুণ লাভের চিন্তা করলে ক্রেতারা কীভাবে কিনবে?”
টাঙ্গাইল সদর থেকে পৌনে চার ফুট উচ্চতার দেশি গরু নিয়ে এসেছেন মো. মিজানুর রহমান। দাম হাঁকছেন এক লাখ ১০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, “এই গরুর বয়স আড়াই বছর। নিজেদের বাড়িতে পালছি। ধলেশ্বরী নদীর পশ্চিম পাড় এলাকার চরে ঘাস খেত। এই চরেই ঘুরেফিরে এটা বড় হয়েছে। কোনো ধরনের ট্যাবলেট বা ওষুধ খাওয়াই নাই।”
ক্রেতা হুমায়ুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ গরু বড় জোর ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি সম্ভব।”
আকার অনুযায়ী গরুর দাম বেশি হয়ে যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে বিক্রেতা মিজান বলেন, “গতবারের চেয়ে তো এই বছর দামডা একটু বেশি। এবার গরমে অনেকের গরু মরছে, আবার অনেক গরু অসুস্থ হইছে। সেগুলোকে চিকিৎসা দিতে অনেক টাকা খরচ হইছে। যে ক্ষতিটা আমাগো হইছে, সেটা তো পোষাইতে হইব। লস দিয়া বিক্রি করে কেউ আর গরু পালব না।”
গরুর দাম ৭০ হাজার পর্যন্ত দাম উঠছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার বেচার নিয়ত কমপক্ষে এক লাখ।”
দাম পড়ার আশায় ইয়াজুল
খিলক্ষেতের ডুমনি এলাকার বাসিন্দা ইয়াজুল ইসলাম হাট ঘুরে দাম যাচাই করলেও তিনি কিনবেন শনি বার রোববার।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “৮০ হাজার টাকা দিয়ে একটা গরু কিনব। কিন্তু চোখের সামনে যা দেখি সব এক লাখের উপরে দাম চায়। আজ গরুর দাম বেশি। কাল একটু কমব, ঈদের আগে আরও কমব। আজ দেখতেছি, দাম অনুযায়ী মিলতেছে না। তাই কাল দেখবো ব্যাপারীরা দাম কমায় কি না।”
দাম না কমে যদি আরো বেড়ে যায়? ইয়াজুল মনে করেন, এটা হবে না। তিনি বলেন, “দেশে গরু তো অনেক, ঘাটতি নাই। তাই দাম ঈদের আগ মুহূর্তে ব্যাপারীরা কমাতে বাধ্য হবেই। যারা বেশি লাভের চিন্তায় মগ্ন তারা নিশ্চিত বিপদে পড়বে।”
কাজী জহিরুল ইসলাম অবশ্য অনিশ্চয়তায় থাকতে রাজি না। তিনি তিনটি গরু কিনেছেন ছয় লাখ ১৫ হাজার টাকা দিয়ে।
যে দামে কিনেছেন, তাতে অসন্তুষ্ট নন এই ক্রেতা। বললেন, “গরু বেশি দেখি নাই। শুধু অল্প কয়েকটা দেখে দাম দর ঠিক করে নিয়ে চলে যাচ্ছি।”
বিক্রি কেমন
বিকালের দিকে খিলক্ষেত ৩০০ ফিট রোড গরুর হাটের হাসিল ঘর-১ এর দায়িত্বে থাকা মো. রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এই বুথের তথ্য মতে ঘণ্টায় বিক্রি হচ্ছে ৫০ টা গরু। আর হাসিল ঘর ৩ এ বেশি বিক্রি হচ্ছে। কারণ, সেটা পুরো বাজারের মাঝখানে। হাসিল ঘর দুই আমাদের মতোই। সেই হিসেবে আনুমানিক বললে বিকেলে ঘণ্টায় দুইশত গরু বিক্রি হচ্ছে।”
বিকাল সাড়ে চারটার পরে অন্তত পনেরো মিনিটের মতো এই হাটের গেটে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, অন্তত ৩০ টির বেশি গরু বের হয়েছে গেট দিয়ে। কিছু হাঁটিয়ে বের করা হচ্ছে, আবার কিছু ছোট পিকআপ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এই হাটের ইজারাদার মাহবুব আলম স্বপন বলেন, “আমাদের এখানে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজারের উপরে গরু আছে। প্রতিক্ষণে গরু ডুকতেছে, আর বিক্রি হচ্ছে।”
এই বাজারে গরু বেচতে গেলে প্রতি হাজারে হাসিল দিতে হয় ৫০ টাকা। এই হিসাবে এক লাখে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা, যা ক্রেতাদের থেকেই নেওয়া হয়।
নীলা মার্কেটের আকর্ষণ রাজা বাবু
নাটোরের বাগাতিপাড়া থেকে আসা খলিল মিয়া চার বছর বয়সী রাজা বাবুর দাম হাঁকছেন ১৫ লাখ টাকা।
রাজা বাবু শাহিওয়াল ও অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের শংকর গরু এটি। এক বছর আগে বড়াইগ্রাম থেকে প্রায় চার লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন তিনি। এই এক বছরে খাওয়াতেওই খরচ হয়েছে লাখ টাকার বেশি।
নীলা মার্কেট হাট শুরু হয়েছে গত তিন বছর আগে। হাট শুরুর প্রথম থেকে প্রতিবারই আসেন খলিল মিয়া। গত বছর লোকসান হয়েছে জানিয়ে এবার একটু বেশি লাভের প্রত্যাশায় তিনি।
রাজা বাবুসহ এবার ২৮ টি গরু এনেছেন এই ব্যাপারি। কিছু গরু নিজের বাড়ির, কিছু গরু কিনেছেন নাটোরের বিভিন্ন হাট থেকে। এই ব্যবসায় অংশীদারও নিয়েছেন।
খলিল বলেন, “এখনও একটাও বিক্রি হয় নাই, হাটে ক্রেতা কম। যারা আসে তারা আমাদের কেনার চাইতেও দাম কম বলতেছে। দেখি আগামী দুই দিন কেমন ক্রেতা আসে।”
রাজা বাবুর দাম আট লাখ পর্যন্ত দাম উঠছে বলেও দাবি করেন তিনি।
গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন কাওসার আলম ও তার সঙ্গীরা। তিনি কুষ্টিয়া থেকে ১৩ টা গরু এনেছেন।
৫ দিনে একটিও বিক্রি হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “মানুষ যে দাম বলে তাতে তো লোকসান হয়।”
‘আশা-ভরসার দাম’ আট লাখ
নীলা মার্কেট হাটে প্রায় একই রকমের গড়নের দুটি দেশি দুই গরুর দেখা মিলেছে, যেগুলোকে আনা হয়েছে কুষ্টিয়া থেকে, দাম চাওয়া হচ্ছে চার লাখ করে আট লাখ টাকা।
বিক্রেতা ইউনুস মিয়া নিজের বাড়িতেই পেলেছেন গরু দুইটিকে। একটির নাম রেখেছেন আশা, একটির নাম ভরসা।
এক বছর আগে ১ লাখ ৭০ হাজার করে কুষ্টিয়া সদর হাট থেকে গরু দুটি কিনে বড় করেন তিনি। গলায় রঙিন মালা পরানো পশু দুটি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ভালোই। দাম উঠছে সাড়ে ছয় লাখ টাকা।
ইউনুস মিয়া বলেন, “আমি এ গরুর দুইটির দাম বাড়িয়ে বলি নাই। একেবারে হাতের নাগালে দাম বলছি। আশা করি আমার এই দামেই বিক্রি করতে পারব।”
আছে ‘ভারতীয়’ গরুও
৩০০ ফিট হাটে বেশ কিছু গরুর গড়ন আলাদা। সারা রঙের আকারে বড় এই জাত দেশে পাওয়া যায় না। ভারত থেকে যখন গরু আসত অবাধে, তখন দেশের হাটগুলোতে এই পশুগুলো তোলা হত। লোকে বলে ‘ভারতীয় গরু’।
এক দশক ধরে ভারত থেকে গরু আনায় কড়াকড়ির মধ্যে এই ধরনের ১২ টা গরু বুধবার রাতে এসেছেন সফিকুর রহমান। তার মত আছে আরও বেশ কয়েকজন ব্যাপারি মিলে এনেছেন ৬০ থেকে ৭০ টি।
কোথায় পেলেন এই গরু? কয়েকজন ব্যাপারি কথা বলতে রাজি হননি। কেউ বলেন, তারা রাজশাহী শহরের বাজার থেকে কিনে এনেছেন, কেউ বলেছেন, মানুষের বাড়ি থেকেও সংগ্রহ করেছেন।
সফিকুর রহমান বলেন, “১২ টি গরুর একটিও বিক্রি করতে পারি নাই। ক্রেতা প্রত্যাশানুযায়ী কম।”
বিনামূল্যে চিকিৎসায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর
৩০০ ফিটের গেট দিয়ে প্রবেশ করে একটু সামনে আগালেই চোখে পড়বে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পশু চিকিৎসা সহায়তা বুথ। এখানে খামারি বা ব্যাপারীরা এসে পরামর্শ নেন। জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে চিকিৎসক পরিদর্শনও করে আসেন।
বুথে বসে থাকা পাঁচজন চিকিৎসকের একজন মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “দূরদূরান্ত থেকে আনার পর দেখা যায় বেশি স্ট্রেসের কারণে গরু অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা, জ্বর, পেট ফুলে যাওয়া বেশি লক্ষ্য করছি।”
মো. সাত্তার নামে এক খামারিকে চিকিৎসা সহায়তা বুথে দৌড়ে আসতে দেখা যায়। তিনি বলছিলেন, তার গরু খাওয়া-দাওয়া করছে না, গাও গরম। জ্বর এসেছে কিনা জানতে চাইলেন।
পরে চিকিৎসক গরুর মাথায় পানি ঢালতে বললেন। এরপর একটু কাঁচা ঘাস ও স্যালাইন খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে বললেন, “এরপরও সমস্যা সমাধান না হলে আমাদের কাছে আবার আসবেন।”