ইউনাইটেডে অবহেলায় বিদেশি পাইলটের মৃত্যুর অভিযোগ

গালফ এয়ারের পাইলটের বোনের সংবাদ সম্মেলনে করা অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2023, 05:19 PM
Updated : 30 Jan 2023, 05:19 PM

ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে অবহেলায় গালফ এয়ারের এক পাইলটের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তার বোন।

ইউসুফ হাসান আল হিন্দি নামে ৬৩ বছর বয়স্ক ওই পাইলট যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের দ্বৈত নাগরিক।

ভাইয়ের মৃত্যুর দেড় মাস পর বাংলাদেশে এসে সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটেতে সংবাদ সম্মেলন করে ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তালা এলহেন্দি জোসেফানো।

জোসেফানোও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, তিনি কাজ করেন ব্রিটিশ সরকারের একটি দপ্তরে। তিনি সংবাদ সম্মেলনে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে যথাযথ চিকিৎসা না দেওয়া এবং রোগীর স্বজনদের সঠিক তথ্য না দেওয়ার অভিযোগ আনেন।

এদিকে জোসেফানোর অভিযোগকে ‘মনগড়া ও অসত্য’ বলে দাবি করেছে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, রোগী ইউসুফ আল হিন্দিকে বাঁচাতে ‘সর্বোচ্চ’ চেষ্টাই চালিয়েছিলেন তারা।

এক যুগ আগে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছিল চিত্রনায়ক মান্নার মৃত্যুর পর।

২০০৮ সালে আসলাম তালুকদার মান্না বুকে ব্যথা নিয়ে বেসরকারি ওই হাসপাতালে গিয়েছিলেন, ভর্তির কয়েক ঘণ্টা পর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মান্নার স্ত্রীর ভাই রেজা কাদের তখন মামলা করেছিলেন। তাতে ছয় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বিচারও শুরু হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ এলে মামলা ঝুলে যায়।

মান্নার মতোই ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয়েছিল ক্যাপ্টেন ইউসুফ আল হিন্দির। তিনি গালফ এয়ারের ফ্লাইট নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে তার ফ্লাইট নিয়ে ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল। ওইদিন ভোর ৪টা ২০ মিনিটে শাহজালাল বিমানবন্দরেই তিনি হঠাৎ পড়ে যান। বিমানবন্দরে তাকে পাঁচ মিনিট কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) দেওয়া হয়। তার রক্তচাপ ক্রমশ কমতে থাকলে তাকে নেওয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে। কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে তার মৃত্যু হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জোসেফানা বলেন, ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সময় তাকে ওষুধ প্রয়োগ করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। সকাল পৌনে ৬টায় ইউসুফকে সিসিএম ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতে সেখানে অন্তত একজন কার্ডিওলজিস্ট থাকা এবং তাৎক্ষণিক বিশেষ সেবা দেওয়ার দরকার ছিল।

“কিন্তু অদক্ষ চিকিৎসকরা অবহেলা করেছেন। কার্ডিওলজি কেয়ারের জন্য একটি ইউনিট করা হলেও সেখানে কোনো কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না। সকাল পৌনে ৭টায় দ্বিতীয় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় আমার ভাইয়ের। ২০ মিনিট পর তৃতীয় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। দুই ঘণ্টার ব্যবধানে আমার ভাইয়ের তিন বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। কোনো কার্ডিওলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ঢাকা শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই হাসপাতালের কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞ ইউনিট আবার ব্যর্থ হয়, যা সিসিএম কর্মীদের চরম অবহেলা ছাড়া কিছু না। তৃতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট করলে সোয়া দুই ঘণ্টা পর্যন্ত তাকে কোনো চিকিৎসা সেবা ছাড়াই ফেলে রাখা হয়। অর্থাৎ তিনি সঠিক চিকিৎসা বঞ্চিত ছিলেন।”

তিনি বলেন, “কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট ট্রিটমেন্টের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চিকিৎসক আমার ভাইকে হেপারিন সোডিয়াম ৫০০০ ইনজেকশন দিয়েছেন। রক্তজমাট বাঁধা বন্ধ করতে এটি দেওয়া হয়। এতে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, রোগীর চিকিৎসায় সেখানে কোনো কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না। কাজেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাদে সাধারণ কর্মীদের পরামর্শ ছিল চরম অবহেলা। বেলা সোয়া ১১টায় ইউসুফের চতুর্থ ও শেষ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তাকে ৪৫ মিনিট সিপিআর দেওয়া হয়। টিপিএম বসানোর পরেই তিনি মারা যান।”

জোসেফানো বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ইউসুফের চিকিৎসা করেছেন ডা. কায়সার নাসির। কিন্তু পরিবারের কাছে চিকিৎসার যে কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে, তাতে তার নাম পাওয়া যায়নি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইউসুফের অ্যাজমা ছিল; যদিও এমন কিছু তারা জানেন না। ফোনে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, কিন্তু তেমন কোনো চিকিৎসক রোগীর কাছে ছিলেন না।

“হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ডা. কায়সার নাসির এসব প্রক্রিয়া করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো কার্ডিওলজিস্ট কি না, তাও পরিষ্কার না। কারণ চিকিৎসার কাগজপত্রে তার নাম উল্লেখ নেই। একজন জ্যেষ্ঠ কনসালটেন্ট (ডা. কায়সার উল্লাহ ও অন্য কনসালটেন্টরা) এনজিওগ্রাম করেছেন বলে তারা জানান। কিন্তু রিপোর্টে তাদের নাম নেই। আর কেন কোনো সার-সংক্ষেপ রিপোর্ট নেই- জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘এগুলো অভ্যন্তরীণ কাগজপত্র’।”

হাসপাতালের সিসিটিভির ভিডিও এবং হাসপাতালের কাগজপত্রে কারসাজি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জোসেফানো। তিনি বলেন, “আমি যখন অনুসন্ধান করছিলাম, তখন হাসপাতালের কর্মীরাও আমাকে ভয় দেখিয়েছেন। তাদের কাছে যখন জানতে চাচ্ছিলাম, তখন তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেন ও রূঢ় ব্যবহার করেন।

“গত ২৬ জানুয়ারি ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে আমি চিকিৎসার কাগজপত্র ও সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চেয়েছিলাম। তারা প্রথমে দিতে চাচ্ছিল না। এরপর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি এবং দূতাবাসকেও এ বিষয়ে জানানো হবে বললে তারা আমাকে কাগজপত্র দেয়। কিন্তু এ জন্য তারা তিন দিন সময় নিয়েছে। এ সময়ে সব কাগজপত্র কারসাজি করা হয়েছে।”

কার্ডিয়াক এরেস্টের রোগীর চিকিৎসার ধরন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকদের কাছ থেকে ধারণা নিয়েছেন জানিয়ে জোসেফানো বলেন, “নিয়মানুসারে ঘণ্টা-খানেকের মধ্যে ইউসুফকে জরুরি চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল, সেখানে ইউনাইটেড হাসপাতালের লেগেছে ছয় ঘণ্টা। ইউসুফের সিএজি (করোনারি এনজিওগ্রাম) করা হয়েছে বলে হাসপাতাল যে প্রমাণ দিয়েছে সেটি জাল বলেও উল্লেখ করেন তালা। ওই অবস্থায় ইউসুফের সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন টেস্ট করানো হয়েছে যেটা হার্ট অ্যাটাক রোগীর জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং তাতে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।”

ক্যাপ্টেন ইউসুফের বোনের ধারণা, রোগীর বিল বাড়ানোর জন্য এসব করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

গালফ এয়ারও তার ভাইয়ের চিকিৎসায় অবহেলা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন জোসেফানো।

তিনি বলেন, “তিনি (ইউসফ) গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটে ওঠার সময় এটা হয়েছে। আর ১০ মিনিট পর তিনি উড়োজাহাজে ওঠার পর এটা হলে ৩০০ লোকের জীবন ঝুঁকিতে পড়ত। কাজেই গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল তিনি যাতে সঠিক চিকিৎসা পান, তা নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা তা করেননি। পরিবারের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে কোনো কর্মকর্তাকে হাসপাতালে পাঠায়নি গালফ এয়ার।”

এ রকম অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে দৃষ্টান্তমূলক জরিমানা কিংবা ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে জোসেফানো বলেন, “অভিযুক্তদের জেলে না ঢুকিয়ে আমি নড়ছি না। তারা মূলত আমার ভাইকে হত্যা করেছেন।”

ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। হাসপাতালটির লাইসেন্স বাতিল করার দাবিও জানান তিনি।

ইউনাইটেডের ভাষ্য

রোগীর বোনের সংবাদ সম্মেলনের পর সোমবার সন্ধ্যায় ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ ব্যবস্থাপক আরিফুল হক স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে ক্যাপ্টেন ইউসুফের চিকিৎসার বিবরণ তুলে ধরা হয়।

তাতে বলা হয়, ওইদিন ভোর ৪টা ৫০ মিনিতে মুমূর্ষু অবস্থায় ইউসুফকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হরে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে ‘সর্বোচ্চ চেষ্টার পর’ সোয়া ১২টার দিকে তিনি মারা যান।

এরপর ইউসুফের সহকর্মীদের কাছে তার এনজিওগ্রামের সিডি, মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট, বুকের এক্সরে, রক্তের রিপোর্টসহ সব রিপোর্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয় বলে জানিয়ে বলা হয়, এরপর পুলিশ ও দূতাবাসের ছাড়পত্রসহ প্রক্রিয়া শেষে ১৫ ডিসেম্বর তার সহকর্মীদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, “এর দেড় মাস পর একজন নারী নিজেকে ইউসুফের বোন বলে পরিচয় দিয়ে ঘটনার দিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও মেডিকেল রেকর্ডস চান। হাসপাতালের নিয়মানুযায়ী রোগীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রমাণকসহ তাকে আবেদন করতে অনুরোধ করা হয়। এরপর তিনি আর যোগাযোগ করেননি। রোগীর ক্লিনিকাল অবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও তিনি অপারগতা জানান।

“এরপর সোমবার তিনি সংবাদ সম্মেলনে যেসব তথ্য তুলে ধরেছেন তার সবই অসত্য ও মনগড়া।”