এনবিআর কর্মকর্তার ছেলের ‘ছাগলকাণ্ডের’ প্রসঙ্গ টেনে মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, “এ রকম হাজার হাজার মতিউর আছেন।”
Published : 26 Jun 2024, 12:06 AM
একের পর এক সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি-বাড়ি, জমিসহ বিপুল পরিমাণ ‘অবৈধ’ সম্পদ অর্জনের তথ্য সামনে আসার প্রেক্ষাপটে তাদের বিষয়ে সংসদে ক্ষোভ ঝেড়েছেন দুইজন সদস্য, যারা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ‘বাগে আনতে’ নানা পরামর্শও দিয়েছেন।
রাজনীতিবিদদের পাশ কাটিয়ে আমলাদের ওপর সরকারের অতি নির্ভরতা এবং আইন করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়ার বিধান ‘শিথিল’ করায় উষ্মা প্রকাশ করে তা সংশোধনের দাবিও তোলেন তারা।
মঙ্গলবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফ এবং লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন এসব বিষয়ে সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য রাখেন।
হানিফ বলেন, দুর্নীতি সরকারের সমস্ত অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির পরও দুর্নীতি দমন করতে পারেনি বা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আজকে বাজারে অস্থিতিশীল দেখা যায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়। বাজার কখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, যদি বাজারে দুর্নীতির অবাধ প্রবাহ থাকে।
কোরবানির ঈদকে ঘিরে কোটি টাকার গরু ও ১৫ লাখ টাকার ‘ছাগলকাণ্ড’ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এবার দুটি ঘটনা সারা দেশে আলোচিত হয়েছে। একটা গরু ১ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। এটা কারা কিনল? কেন কিনল?
“বৈধ উপায়ের আয়ে এটা কিনতে পারে না। অবৈধ উপায়ে যাদের আয়, তারা খামখেয়ালিভাবে এভাবে কিনতে পারে। একটা ছাগল কিনল ১৫ লাখ টাকা দিয়ে। এটা কারা করতে পারে? যাদের অবৈধ আয় আছে, তারা। বৈধ আয়ে কখনও টাকা পানিতে ফেলতে পারে না। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দুর্নীতিটাকে আগে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।”
তিনি বলেন, “সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানো হয়েছে। তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারপরও কেন দুর্নীতি হবে? আজকে দুর্নীতি কথা উঠলে সকলে প্রথমে আঙুল ওঠায় রাজনীতিবিদদের দিকে। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত- এটা দেশে প্রচলন আছে। অথচ সংসদ সদস্যদের মধ্যে মন্ত্রী ছাড়া কারও নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তারা কীভাবে দুর্নীতি করবেন। “
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ বলেন, “দুর্নীতি হয় তো সরকারের উন্নয়ন ও কেনাকাটায়। সেখানে একজন রাজনীতিবিদের সুযোগ কোথায়, যদি সরকারি কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত না থাকেন? ২০১৮ সালে জনপ্রশাসনে তথ্য এসেছিল, ১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়েছিল।”
এরপর এনবিআর কর্মকর্তার ছেলের ‘ছাগলকাণ্ডের’ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এ রকম হাজার হাজার মতিউর আছেন। দফায় দফায় তাদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে, তারপরও দুর্নীতি কমানো সম্ভব হয়নি।”
‘সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৮’ এর দুর্বল দিক তুলে ধরে হানিফ বলেন, “দুর্নীতির বিধি-বিধানকে বরং আরও নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে তাদের চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে।”
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে তাদের গ্রেপ্তারে অনুমতি নেওয়া লাগে না। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করেছে।”
আইনটি সংশোধনের জন্য পুনর্বিবেচনার পরামর্শ রেখে কুষ্টিয়া-২ আসনের এই সংসদ সদস্য বলেন, “সরকারি চাকরিজীবীরা এক বছরের কম শাস্তি পেলে চাকরি থেকে অব্যাহতি পান না। এ ক্ষেত্রে তাকে তিরস্কার, বিভাগীয় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে; যা সুশাসনের সহায়ক না। অথচ স্থানীয় প্রতিনিধিদের এরাই তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখে। এই আইনের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটা কার্যত অপরাধী সুরক্ষা আইন হিসেবে বিবেচিত।”
দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে প্রথমে ভোগের রাস্তা বন্ধ করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, রেজিস্ট্রি অফিস, গাড়ির শো-রুম, স্বর্ণালংকারের দোকান এসব জায়গায় প্রতি মাস শেষে যারা জমি, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট রেজিস্ট্রি করেছেন, কেনাকাটা করছেন; তাদের তালিকা নিয়ে বিশেষ টিম পাঠিয়ে আয়ের বৈধ উৎসের বিষয়ে কৈফিয়ত চাওয়া হোক।
“আমার বিশ্বাস, তাহলে অবৈধ আয়কারীদের ভোগ বিলাস বন্ধ হবে।”
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহির আওতায় আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি চাকরিতে নিয়োগের সময় হলফনামা বাধ্যতামূলক করার কথা বলেন।
১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরোধিতাও করেন তিনি।
সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন আমলাদের এত গাড়ি-বাড়ির উৎস কোথায়, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, “আজকে আমরা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। আমি ১৯৮৫ সালে যখন উপজেলা চেয়ারম্যান হই, তখন হাতিবান্ধায় ১০টি ইউনিয়ন ছিল। ১৯৮৭ সালে সার্ভে করে হিসাব করলাম ইউনিয়নগুলোর পাকা বাড়িগুলো কাদের। দেখলাম ৯২ শতাংশ বাড়ি হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের। এখন তো আর বলাই যাবে না। এত বাড়ি, এত জমি এত ঘরবাড়ি হল; আমাদের এত ইন্টেলিজেন্স, কেউই টের পেল না। রক্ষক ভক্ষক হলে যা হয়। সেটাই হয়েছে। এদের হাতেই সবকিছু।”
মাঠ প্রশাসনে আমলাদের ওপর ‘অতি নির্ভরতা‘য় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমি প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থাকতে নিয়োগ কমিটিতে জেলা প্রেসিডেন্ট বা সাধারণ সম্পাদককে সদস্য রেখেছিলাম। তিন বছর আগে সেটাও তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা সব পলিটিশিয়ানরা না কি দুর্নীতি করি। আর উনারা সব ‘ভালো’ কিছু করেন; অন্য কিছু করেন না।
”উনারা বাড়ি-গাড়ি করেন দেশে-বিদেশে, বেগমপাড়ায়। আরও কোন কোন পাড়ায় যেন বাড়ি করেন। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। আজকে দোষ কিন্তু আমাদেরই, পলিটিশিয়ানদেরই।”
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে ইঙ্গিত করে মোতাহার হোসেন বলেন, ”ব্যারিস্টার সাহেব বলে ফেলছেন। ফেইসবুকে দিয়ে দিয়েছেন। উনি নাকি ২৮ কোটি টাকা পেয়েছেন। উনি এই টাকা পেলেন, রাখলেন কোথায়? কোন ব্যাংকে রেখেছেন। এ হিসাব কী উনি দিতে পারবেন?
”২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে ৫ বছরের উন্নয়ন কাজের জন্য। মানে বছরে ৫ কিলোমিটার করে রাস্তা আমরা করতে পারব। সেটা আবার আমরা দেব প্রস্তাব, এলজিইডি করবে সার্ভে; টেন্ডারও করবে তারা। ওয়ার্ক অর্ডারও দেবে তারা। তাহলে আমরা কোথায় টাকা পেলাম?”
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একরামুজ্জামান শেয়ারবাজার ও শিল্পে কালো টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়ার দাবি তোলেন।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ বলেন, ব্যাংক খাতে অন্যতম সমস্যা খেলাপি ঋণ। এখন এই ঋণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। এই টাকা পাচার হচ্ছে। তারল্য সংকট কাটিয়ে ব্যাংক খাত কীভাবে ঠিক করা যায়, তা দেখতে হবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরোধিতা করেন। তিনি করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়িয়ে সরকারের আয় বাড়ানোর তাগিদ দেন।