“আমাদের অনেক বিষয়েই আপত্তি ছিল। তবে আমরা রাষ্ট্রপতির এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই,” বলেন স্কপ নেতা ওয়াহেদ।
Published : 05 Dec 2023, 10:58 PM
জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল, ২০২৩’ এ রাষ্ট্রপতি অসম্মতি জানানোর পর উপেক্ষিত থাকা দাবি আদায়ে নতুন করে আশা দেখছেন শ্রমিক নেতারা।
নিজেদের দাবিগুলো আইনের সংশোধনীতে উপেক্ষিত থাকায় এ আইন পাসের বিরোধিতা করে আসছিল শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) এবং আরও কয়েকটি শ্রমিক জোট।
গত ২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল, ২০২৩’। এরপর ৮ নভেম্বর বিলে সম্মতির জন্য পাঠালে একটি দফা পুনর্বিবেচনার জন্য গত ২০ নভেম্বর তা ফেরত পাঠান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
আইনটি সংশোধনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পরিষদের (টিসিসি) সদস্য ছিলেন শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) নেতা রাজেকুজ্জামান রতন।
মঙ্গলবার সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রতন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাষ্ট্রপতি যে কারণ উল্লেখ করে আইনটি ফেরত পাঠিয়েছে, সেটা আমাদের আপত্তির মধ্যে ছিল। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলোর একটি নয়।”
জাতীয় শ্রমিক জোটের কার্যকরী সভাপতি ও স্কপ নেতা আবদুল ওয়াহেদ বলেন, “শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আইনের সংশোধনী যেগুলো হয়েছে, সেটাই আমরা গ্রহণ করি নাই। তবুও সেটা পাস হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চলে গেছে।
“আমরা মনে করি, সামনে নির্বাচন বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর চাপে এখন হয়তো অসামঞ্জস্যের কথা বলে আইনটি থামানো হয়েছে। আমাদের অনেক বিষয়েই আপত্তি ছিল। তবে আমরা রাষ্ট্রপতির এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।”
‘সংসদে গৃহীত বিল পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির বার্তা’য় বলা হয়েছে- “এ বিলটি-বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল, ২০০৩ গত ৮ নভেম্বর আমরা নিকট পেশ করা হয়। এই বিলের দফা-৪৫ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। কাজেই এই দফা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠানো হলো।”
২০০৬ সালের শ্রম আইনে দুটি উপধারায় বেআইনি শ্রমিক ধর্মঘট এবং মালিকপক্ষের বেআইনি লকআউটের ক্ষেত্রে যে শাস্তি ছিল, তার কিছুটা সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়।
ওই আইনে কোনো শ্রমিক কোনো বেআইনি ধর্মঘট করলে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। কোনো মালিকও কোনো বেআইনি লকআউট করলে ঠিক একই শাস্তির মুখোমুখি হবেন বলে আইনি বিধান করা হয়।
এবার আইনটির যে সংশোধনী প্রস্তাব সংসদে পাস হয়েছে, সেখানে শ্রমিকদের বেআইনি ধর্মঘটের ক্ষেত্রে জরিমানা ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হয়। কিন্তু মালিকদের ক্ষেত্রে জরিমানা আগের মতই ৫ হাজার টাকা রাখা হয়েছে।
শ্রমিক নেতা রতন বলেন, “শ্রম আইনের শ্রমিকদের মূল দাবি ছিল আইএলও কনভেনশনের ৮৭ ও ৯৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী শ্রমিকদের যেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বিঘ্নে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয়। শ্রমিকরা যেন সম্মিলিতভাবে তাদের স্বার্থ রক্ষায় দরকষাকষি করার সুযোগ পায়, কিন্তু সংশোধনীতে সেটা হয়নি।
“এখন একটা কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে ওই কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিকের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা অত্যন্ত কঠিন।”
তিনি বলেন, “আরেকটি দাবি ছিল- গ্রাচ্যুয়িটি সুবিধাটি সব শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া দরকার। গ্রাচ্যুয়িটির ক্ষেত্রে আইনে বলা আছে ‘যদি প্রাপ্য হয়’। এই বক্তব্যটা প্রত্যাহার করার কথা বলেছি। কারণ এই কথাটির কারণে অনেক মালিক গ্রাচ্যুয়িটি দেন না। এই বিষয়টা আইনে আসে নাই।
“মাতৃত্বকালীন সুরক্ষার ক্ষেত্রে ছয় মাসের ছুটির দাবি ছিল, যেটা এখন চার মাস রয়েছে। এটাও নতুন আইনে আসেনি। এই বৈষম্যগুলো দূর করা হয়নি। এখন মালিকরা যাকে ইচ্ছা তাকে গ্রাচ্যুয়িটি সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু এটা আইনে বাধ্যবাধকতা জরুরি ছিল।”
এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ের মধ্যে আনার দাবিটিও উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে করেন রতন।
তিনি বলেন, গৃহ শ্রমিক, হালকা যানবাহন চালক, উবার চালক, ডেলিভারি ম্যান- এ ধরনের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। এগুলো আইনে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে হবে।
গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (জি-স্কপের) সদস্য আহসান হাবিব বুলবুল বলেন, “শ্রমিক সংগঠনগুলো সন্তুষ্ট ছিল না। এখন রাষ্ট্রপতি ফেরত পাঠিয়েছে। সরকার পাস কাটিয়ে যাচ্ছিল।
“রাষ্ট্রপতি এখন শ্রমিকদের উপকারই করেছে। রাষ্ট্রপতি ২০ তারিখে ফেরত পাঠিয়েছেন। অথচ ১৪ দিন পরেও বাণিজ্য সচিব ও শ্রম সচিব বিষয়টি স্বীকার করছেন না।”
সোমবার শ্রমিক অধিকার নিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো নিয়ে বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। সেখানে শ্রম সচিব, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ প্রতিনিধি ছিলেন।
শ্রম পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপ আসার হুমকির বিষয়ে সেই বৈঠকে আলোচনা করা হয়।
তবে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সংশোধিত শ্রম আইন ফেরত আসার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেননি বাণিজ্য কিংবা শ্রম সচিব।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ তখন বলেছিলেন, “আমরা শ্রম পরিস্থিতির অগ্রগতি যা হয়েছে এবং সামনের দিকে যা করা যাবে, সেগুলো নিয়ে আলাপ করেছি। বাংলাদেশ শ্রম আইন ও বেজা আইনে বেশ সংশোধনী আনা হয়েছে। এগুলোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু চাওয়া ছিল। সেগুলো পূরণ করার জন্যই এই সংস্কারগুলো আনা হয়েছে।”