দালাল চক্রটি ৫০ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করেছে। প্রতিবাদ করায় তাকে ভারতে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়, মামলায় অভিযোগ।
Published : 12 May 2024, 07:40 PM
চাকরির কথা বলে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার বেকার যুবক রবিনকে; পরে দীর্ঘদিন আটকে রেখে তার একটি কিডনি দিতে বাধ্য করা হয়। এর আগে প্রায় ১১ মাস ধরে চক্রটি তার সঙ্গে নানা কৌশলে সম্পর্ক বজায় রেখে প্রতিবেশী দেশটিতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
ভারত থেকে ফিরে এসে কিডনি হারানো মিরপুরের সেই যুবক ধানমন্ডি থানায় মামলা করলে এমন একটি চক্রের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এদের গ্রেপ্তারের পর রোববার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) খ. মহিদ উদ্দিন বলছেন, এরা কিডনি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত আন্তঃদেশীয় দালালচক্রের সদস্য।
গ্রেপ্তার তিনজন হচ্ছেন- মো. রাজু হাওলাদার (৩২), শাহেদ উদ্দীন (২২) ও মো. আতাহার হোসেন বাপ্পী (২৮)।
তবে রবিনকে ফুসলিয়ে ভারত নিয়ে যাওয়া মাছুম নামের এক ব্যক্তির খোঁজ এখনও পায়নি পুলিশ।
এদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কর্মকর্তা মহিদ উদ্দিন বলেন, মানুষের অভাব-অনটনকে পুঁজি করে এ চক্র প্রতারণার মাধ্যমে ভয়-ভীতি দেখিয়ে কিডনি নিয়ে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে থাকে।
তিনি জানান, এ চক্রের খপ্পরে পড়ে ভারতে গিয়ে কিডনি হারান মিরপুরের বাসিন্দা বেকার যুবক রবিন। তিনি দেশে ফিরে ধানমন্ডি থানায় অভিযোগ দায়ের করলে পুলিশ এ চক্রের সন্ধানে মাঠে নামে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শনিবার এদের একজনকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের সামনে থেকে এবং তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অপর দুইজনকে রোববার ভোরে বাগেরহাট থেকে গ্রেপ্তার করে।
চক্রটি অত্যন্ত সক্রিয় জানিয়ে অতিরিক্ত কমিশনার মহিদ উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভারতেও তাদের সদস্য রয়েছে। সাধারণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, ভয়ভীতি দেখিয়ে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে সুকৌশলে কিডনি দিতে বাধ্য করে।
রবিনের দায়ের করা মামলায় কীভাবে তাকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ভারত নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে রেখে কিডনি কেটে নিয়েছে এবং অনেক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছে তা তুলে ধরা হয়।
এজাহারের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মহিদ উদ্দিন বলেন, গত বছর এপ্রিলের এক দিন মিরপুর ১০ নম্বর শাহ আলী মার্কেটের পেছনে চায়ের দোকানে রবিনের সঙ্গে মাছুম নামের একজনের পরিচয় হয়। রবিনের অভাব অনটনের কথা শুনে মাছুম নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে ভারতে চাকুরির প্রস্তাব দেয়। পরে নিজেদের মধ্যে মোবাইল ফোনে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কথা বলার সময় রবিনকে চাকুরির বিষয়ে নানাভাবে প্রলুদ্ধ করে।
তাদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চলা আলাপের এক পর্যায়ে ভারতে চাকরির জন্য যেতে হলে কিছু মেডিকেল টেস্ট লাগবে বলে তাকে বলা হয়। এজন্য সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে রবিনকে ধানমন্ডির ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে চক্রের আরেক সদস্য রাজু হাওলাদারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় মাছুম।
এরপর রবিনকে পাসপোর্ট করিয়ে দেয় মাছুম। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে শাহেদ উদ্দিন ও আতাহার হোসেন বাপ্পী নামে দুইজনকে তার ব্যবসায়িক অংশীদার বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে তার ভারত যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর তিন মাস পর ২২ ডিসেম্বর আকাশপথে একাই দিল্লিতে যান রবিন।
অতিরিক্ত কমিশনার মহিদ উদ্দিন বলেন, “রবিন আমাদের জানিয়েছে, শাহীন (৩৫) এবং সাগর ওরফে মোস্তফা (৩৭) নামের দুইজন তার ছবির প্লাকার্ড ধরে দিল্লি বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে রিসিভ করে। সাক্ষাতের পরপরই পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে একটি ভাড়া করা ট্যাক্সিতে করে ফরিদাবাদ এলাকায় একটি বাসায় নিয়ে আটকে রাখে।”
ঘটনার বর্ণানায় তিনি বলেন, সেখানে প্রায় ২৫ দিন আটকে রেখে তাকে কিডনি দিতে নানাভাবে প্রলুদ্ধ, ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ সময়ের মধ্যে মাছুম সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখাও করে আসে। কিন্তু রবিনের চাকুরির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে পরিবারের অভাব অনটনের কথা বলে কিডনি দিতে চাপ দেয়।
“পরে জোর করে দিল্লির একটি হাসপাতালে নিয়ে রবিনের কিডনি সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল নিয়ে সেখান থেকে তাকে গুজরাটে নিয়ে যায়। গুজরাটের একটি হাসপাতালেই এ বছর ৪ মার্চ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি কিডনি বের করা হয়।”
রবিন পুলিশকে বলেছে, ওই হাসপাতাল থেকে চার দিন পর ছাড়া পেলেও ওই চক্রের হাতে আরও দুই সপ্তাহের মত তাকে আটক থাকতে হয়েছিল।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, দালাল চক্রটি ৫০ লাখ টাকায় তার কিডনি বিক্রি করেছে। এর প্রতিবাদ করায় তাকে ভারতে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। পরে তার স্ত্রীর কাছে বিকাশের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা পাঠিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এ চক্রের প্রধান মাছুমসহ অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে জানিয়ে ডিএমপির এই কর্মকর্তা বলেন, রবিনের সঙ্গে পরিচয়ের প্রায় ১১ মাস পর চক্রটি তাকে ভারতে নিয়ে যেতে সফল হয়। এ চক্রের বিরুদ্ধে আর কারও অভিযোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।