“তাদের মধ্যে ৫৪ জনকে মাথায় বা গলায় গুলি করা হয়েছিল। অধিকাংশের বয়স ছিল ৪০ বছরের মধ্যে। ঢাকায় হতাহতের মাত্রা এত বেশি ছিল যে একটি হাসপাতালে আক্ষরিক অর্থেই গজ ও ব্যান্ডেজ ফুরিয়ে যায়।”
Published : 16 Jan 2025, 01:52 AM
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই এক দিনেই নিহত হন ১৪৮ জন নিহত হন বলে উঠে এসেছে ‘ব্লাডশেড ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি) এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট (টিজিআই) এর তৈরি করা এই প্রতিবেদন বলছে, সেদিন নিহত ১৪৮ জনের মধ্যে ৫৪ জনকে মাথায় বা গলায় গুলি করা হয়েছিল। অধিকাংশের বয়স ছিল ৪০ বছরের মধ্যে। ঢাকায় হতাহতের মাত্রা এত বেশি ছিল যে একটি হাসপাতালে আক্ষরিক অর্থেই গজ ও ব্যান্ডেজ ফুরিয়ে যায়।
বুধবার বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইটিজেপি ও টিজিআই।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, শেখ হাসিনা সরকার পতনের কয়েকদিন পর তারা প্রমাণ সংগ্রহ করতে মাঠে নামে এবং পরিবারগুলো ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নেয়।
এই প্রতিবেদনের পাশাপাশি দুটি প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করা হয়। সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া পুলিশি নির্যাতনের ভিডিওগুলো প্রমাণ হিসেবে একত্রিত করে কী ঘটেছিল তা বোঝানোর চেষ্টা করে হয়েছে এসব প্রামাণ্যচিত্রে।
একটিতে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ বিপুল সংখ্যক তরুণ আন্দোলনকারীদের ঠান্ডা মাথায় হত্যা করছে। আর অন্যটিতে ৫ অগাস্ট গাজীপুরে মোহাম্মাদ হৃদয় নামে এক তরুণকে ধরে নিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
নিহতদের পরিবারগুলোকে কতটা যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, পুলিশের গুলিতে আহত সন্তানদের খুঁজতে কীভাবে হাসপাতালের মর্গে ঘুরে বেড়াতে হয়েছ, সেসব চিত্রও উঠে এসেছে ৬০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে।
প্রবল মানসিক আঘাতের মধ্যেও শোকাহত পরিবারগুলোকে ‘ক্ষমতাসীনদের বৈরিতা’ মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রিয়জনের মৃতদেহ দাফনের জন্য মৃত্যু সনদ ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সংগ্রহ করতেও নানা ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। ভয় এবং আতঙ্কে আচ্ছন্ন ছিল দাফনের আয়োজন, যেখানে কিছু পরিবার বাধা এড়াতে ভোরের আলো ফোটার আগেই গোপনে দাফন সম্পন্ন করেছে, যাতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মীদের কোনো বাধার মুখে পড়তে না হয়।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, শহীদ হৃদয়ের বোন জেসমিন ও শহীদ মুনতাসীর রহমান আলিফের বাবা গাজীউর রহমান, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, আইটিজেপির নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন সুকা, টেক গ্লোবাল ইনস্টিউটের নির্বাহী পরিচালক শাহানাজ রশিদ দিয়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
হৃদয়ের বোন জেসমিন বলেন, “আমার ভাইরে মাইরা আবার পুলিশ লাশটা নিয়া গেছে, লাশটারে দেয়ও নাই। ভাইয়ের খোঁজ পাইনি। কোথায় রাখল, কোন জায়গায় রাখছে, খুঁইজাই পাইলাম না। আপনাগো কাছে একটাই দাবি, আমার ভাইয়ের লাশটা কোন জায়গায় কী করছে তদন্ত কইরা খুঁজে আইনা দেবেন। হাড্ডিটা পাইলেও দেশের বাড়িতে ভাইরে মাটি দিমু। অন্তত দেখমু ভাই বাড়ির পাশে আছে।”
মুনতাসিরের বাবা গাজীউর রহমান বলেন, “আজ পর্যন্ত যত কেস হয়েছে যাত্রাবাড়ী ছাড়া আর কোথাও কেউ অ্যারেস্ট হইছে দেখি না। তাহলে কী হইতেছে, আজকে ৫-৬ মাস হয়ে গেছে কোনো পুলিশ হেলমেট বাহিনী অন্তত আমার মামলায় কেউ অ্যারেস্ট হয়নি। এদের যদি বিচার না হয়, তাহলে আমাদের কী হবে, আমরা প্রত্যেকে তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছি।”
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “যখনই অত্যাচারে মৃত্যুর দৃশ্য দেখি, মনে হয় বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার নাই। আমাদের প্রসিকিউশন টিম তদন্ত টিম কাজ করছে, আমি কথা দিচ্ছি, এটার সুবিচার নিশ্চিত করবই। এ সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব জুলাই অভ্যুত্থানে সুবিচার নিশ্চিত করা। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচারের চেয়ে আমাদের বিচার যে ভিন্ন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি বলেন, “আপনাদের মত আমাদেরও তাড়না থাকে, কালকেই যদি বিচার হত, খুশি হতাম। কিন্তু আমাদের তো প্রসেস মেনটেইন করতে হবে। আমাদের এত অকাট্য প্রমাণ এত সাক্ষী আছে, ডিউ প্রসেস মেনটেইন করে বিচার করতে পারব।”
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “তারা যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে, তাদেরকে শনাক্ত করার পাশাপাশি এটা বের করা জরুরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠল? কেন রাষ্ট্র এ পর্যায়ে গিয়েছিল, কার নির্দেশে তারা এ কাজ করেছিল? এগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি। এভাবে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা সর্বত্র হয়েছে, একই মাত্রায় একই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে হত্যার গায়েবি নির্দেশ কোথা থেকে এসেছে সেটা যদি বের করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে সুপিরিয়র কমান্ড কতটুকু সম্পৃক্ত হয়েছিল।”
তিনি বলেন, “শহীদ পরিবারের পর্বতসম বেদনা আমরা বুঝি। তাদেরকে ন্যায়বিচার দিতে হবে, পাশাপাশি বিচার প্রক্রিয়া যেন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য করা যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে অতীতের মত ট্রাইবুনালকে কলঙ্কিত করা হবে।”