ছবি মেলাযুদ্ধ ও জীবনের ছবি

দৃক আয়োজিত চলমান আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র উৎসব 'ছবি মেলা'-র অংশ হিসেবে বেঙ্গল গ্যালারিতে চলছে 'এ পিপল ওয়্যার' (জনগণের এক যুদ্ধ) শীর্ষক প্রদর্শনী। এক দশক স্থায়ী মাওবাদী বিদ্রোহে নেপালী মানুষের জীবনে সৃষ্ট বিপর্যয় ও তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্রই ফুটে উঠেছে এতে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন হুমায়ুন হাশিম

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2009, 09:27 AM
Updated : 6 Feb 2009, 09:27 AM
ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ৬ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)-- দৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র উৎসব 'ছবি মেলা'-র অংশ হিসেবে বেঙ্গল গ্যালারিতে চলছে 'এ পিপল ওয়্যার'। নেপালের মানুষের জীবনে গত এক দশকের মাওবাদী বিদ্রোহের যে অভিঘাত তা-ই তুলে ধরা হয়েছে এই ভ্রাম্যমান প্রদর্শনীটিতে।
সহিংস আন্দোলনের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অহিংসার বাণী ছড়িয়ে দেওয়াও এর অন্যতম লক্ষ্য।
৮০ জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীর তোলা এই ছবিগুলো একইসঙ্গে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো, আশা, সংগ্রাম এবং শেষ পর্যন্ত অহিংস আন্দোলনের বিজয়ের কথা বলে।
সকল প্রতিকূলতা, নিরাশার মাঝেও নেপালি জনগণ শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে এবং তারা অবশেষে জয়ী হয়েছে।
হিমালয়-দুহিতা নেপালে এক দশকের যুদ্ধ শেষ হয়েছে দু'বছর আগে। রক্তক্ষয়ী এই সংঘাত দেশটিকে ঠেলে দিয়েছিল ধ্বংসের মুখে। মাওবাদী বিদ্রোহ দেশটির সামাজিক বিন্যাসকে করেছে ছিন্নভিন্ন।
নেপালি সাংবাদিক কুন্ড দীক্ষিতের 'আ পিপল ওয়্যার- ইমেজেস অব নেপাল কনফ্লিক্ট ১৯৯৬-২০০৬' শীর্ষক বই থেকে এই প্রদর্শনীর ছবিগুলো নেওয়া হয়েছে। বইটির জন্য ১০ বছর ব্যাপী চলা এ সংঘাতের সময় তোলা ছবি চাওয়া হয়েছিল সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের কাছে। তিন হাজার ছবি জমা পড়ে। সেগুলো থেকে এই বইয়ে স্থান পায় বাছাই করা ১৭২টি আলোকচিত্র।
নেপালে ৩০টিরও বেশি জায়গায় প্রদর্শনীটি 'ভ্রমণ' করেছে। এটি দেখেছেন সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ । নেপালে এ পর্যন্ত এটাই বৃহত্তম ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী।
ঢাকায় চলমান 'ছবিমেলা-৫'এ প্রদর্শনীটি উপস্থাপন করছে কাঠমান্ডু ভিত্তিক 'ফটোডট সার্কেল' নামে একটি আলোকচিত্রী গোষ্ঠী।
প্রদর্শনীর একটি ছবিতে এক দুখিনী মা তার ছেলের নাগরিকতার সনদপত্র দেখাচ্ছেন। ২০০৪ সালে সেনাবাহিনী তার ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আজও তার খোঁজ মেলেনি। ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী রামেশ্বর বোহারা।
২০০৬ সালে মধ্য নেপালের সিধুপালচক জেলায় মাওবাদীদের এক সমাবেশে সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার গানশিপ নিয়ে হামলা চালায়। সে ঘটনার ছবিতে নিহত এক ব্যক্তির পাশে পড়ে আছে তারই কয়েকটি গবাদিপশুর লাশ। ছবিটির ফটোগ্রাফার কিয়োকা ওগুরা।
মোহন মাইনালির তোলা ছবিতে গুর্খা অধ্যুষিত এক প্রত্যন্ত গ্রামের একটি শিশু আনমনে ব্ল্যাকবোর্ডে পাখি ও বাড়ির পাশাপাশি আঁকছে হেলিকপ্টারের ছবি!
ফটোগ্রাফারের ক্রেডিটবিহীন একটি নৃশংস ছবি রয়েছে প্রদর্শনীতে। ছবির ফটোগ্রাফার আজও প্রতিহিংসার ভয়ে তার নাম প্রকাশ করতে চান না। এক শিক্ষককে শ্রেণীকক্ষ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মাওবাদীরা। গাছের সঙ্গে পিঠমোড়া করে বেধে হত্যা করা হয় তাকে।
এলিজাবেথ ড্যালজিয়েলের ছবিতে সংঘাতে মা-বাবা হারানো কয়েকটি শিশুর বেদনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নেপালগঞ্জের একটি এতিমখানায় এরকম কয়েকজন শিশু তাদের ডরমিটরির জানালা দিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে যেন অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের পানে।
ওই সময় মাওবাদীদের আন্দোলনে অনেক কিশোর, তরুণ-তরুণীও যোগ দিয়েছিল। তাদেরকেই ছবিতে তুলে এনেছেন আলোকচিত্রী মুকুন্দ বোগাতি। তার একটি ছবিতে একটি গেরিলা ক্যাম্পে এক ব্যক্তি তার ১৪ বছর বয়সী ভাগ্নেকে বোঝাচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে ঘরে ফিরে যেতে। কিন্তু কিশোর গেরিলাটি তাকে ফিরিয়ে দেয়।
সুন্দর শ্রেষ্ঠর তোলা ছবিটি সত্যিই অন্যরকম। এতে দেখা যায় ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভ চলার সময় বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে একজন পুলিশকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদেরই একজন।
প্রদর্শনীর ছবিগুলোতে বিপর্যস্ত মানুষের কাহিনী বলার পাশাপাশি মানবতার এই জয়গানও যেন গাওয়া হয়েছে।
'আ পিপল ওয়্যার-ইমেজেস অব নেপাল কনফ্লিক্ট ১৯৯৬-২০০৬' গ্রন্থের ভূমিকায় কুন্ড দীক্ষিত লিখেছেন, "এই ছবিগুলোতে সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত একটি দেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে নেপালি জনগণের অন্তর্গত শক্তি যা এই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার মাঝেও তাদেরকে আবারও জীবন পুনর্গঠনে প্রেরণা দিয়েছে।"
নেপালের বিভিন্ন শহর ঘুরে ঢাকায় আসা এ প্রদর্শনী চলবে ৯ ফেব্র"য়ারি পর্যন্ত। এটি দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এইচএ/এসকে/২১০১ঘ.