বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বসবে হাট। তবে পশু আসতে শুরু করেছে সোমবার থেকেই। টুকটাক বিক্রিও হচ্ছে।
Published : 13 Jun 2024, 12:04 AM
কোরবানির পশু কেনাবেচায় ঢাকায় এবার যে হাটগুলো বসেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হওয়ার আগের দিনও পশু সেভাবে উঠেনি।
সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীতে বুধবার বিকাল পর্যন্ত বেশ ফাঁকাই দেখা যায়, যা আগামী দুই এক দিনে পশুতে ঠাসা হয়ে যাবে।
ভাটারায় একশ ফিট এলাকার হাটটি আরও ফাঁকা দেখা গেছে, হাট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে সেটি ভরে যাবে বলে আশা করছেন তারা।
দক্ষিণ বনশ্রী-মেরাদিয়ায় যে হাট বসেছে, সেখানে ফাঁকা জায়গা নেই, রাস্তার দুই পাশে পশু রাখার ব্যবস্থা হয়েছে, ফলে আগামী কয়েকটি দিন এই সড়ক ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
আগামী ১৭ জুন ঈদকে সামনে রেখে এবার রাজধানীতে ২০টি পশুর হাট বসানোর অনুমতি দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। তবে বরাবরের মত এবারও অনুমোদিত হাটের বাইরেও কেনাবেচার জন্য পশু আনার উদ্যোগ চোখে পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু হাটে বিক্রি শুরু হয়েছে, কিন্তু সেটার সংখ্যায় খুব বেশি নয়। পশুর মত ক্রেতার সংখ্যাও খুব বেশি চোখে পড়েনি। বিক্রেতারা প্রত্যাশা করছেন বৃহস্পতিবার থেকেই পুরোদমে বিক্রি শুরু হবে।
বুধবার তিনটি বড় হাট ঘুরে দেখা যায়, হাটগুলোতে পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নকল টাকা পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।
তবে গাবতলীর হাটে গরু নামানোর সিরিয়াল নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় জানিয়েছেন একজন ব্যাপারী।
দিনাজপুর থেকে তিনটি গরু নিয়ে গাবতলীতে হাটে এসেছেন মো. ইলিয়াস হোসেন। তিনি বলেন, “রাত একটায় গরু আসছে। নামানোর সিরিয়াল না পাওয়ায় আজ বিকালে নেমেছে। এজন্য গরু অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। এটা আমাদের একটা বড় ভোগান্তি।
“আবার গরু নামানো যাচ্ছিল না এই সুযোগে হাজারীবাগের ও দিয়াবাড়ির কিছু পোলাপান এসে গত রাতে আমাদের পরিচিত কিছু মানুষের গরুভর্তি গাড়ি জোরজবরদস্তি করে হাজারীবাগে ও দিয়াবাড়ির হাটে নিয়ে চলে গেছে।”
গাবতলী হাটের ইজারাদার অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ডিপজল। তার ছেলে দেশ অ্যাগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজের চেয়ারম্যান সাদাব মনোয়ার ফাহিম ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ফাহিম বলেন, “আমাদের গরু নামানোর ব্যবস্থা একটা ছিল। তখন একটু গ্যাদারিং হয়েছে। এখন আরেকটা গেট খুলে দিয়েছি। এখন গরু নামানোর সিরিয়াল নিয়ে সমস্যা হচ্ছে না।”
বুধবার বিকাল পর্যন্ত আট হাজারের বেশি গরু এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখনও অনবরত পশু আসছে।”
গাবতলীতে ‘ব্ল্যাক টাইগার’
ময়মনসিংহের ফুলপুর থেকে ‘ব্ল্যাক টাইগার’ নামের একটি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন নূরুল আমিন। এখন পর্যন্ত যতগুলো গরু এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড়গুলোর একটি এটি।
অস্ট্রেলিয়ান জাতের এই গরুটি তিনি সাড়ে তিন বছরের বেশি লালনপালন করেছেন নুরুল আমিন। দাম চাইছেন ১০ লাখ টাকা।
শাহীওয়াল ও ফ্রিজিয়ান জাতের শংকর একটি গরু নিয়ে এসেছেন শাহজাহান কবির, তিনিও দাম চাইছেন সাড়ে ১০ লাখ টাকা। নিজের বাড়িতে এই একটি গরুই পালন করেছেন তিনি।
পাকিস্তান থেকে জাহাজে এল উট
এরই মধ্যে হাটের আকর্ষণ হয়ে উঠেছে দুটি উট দেখা গেল, একটির দাম চাওয়া হচ্ছে ২৫ লাখ, আরেকটি ২৬ লাখ।
হাটের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ডানদিকে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা মিলবে প্রাণী দুটির। ক্রেতাদের অনেককেই সেখানে ভিড় করতে দেখা গেল। কেউ করছিলেন ভিডিও, কেউ ছবি তুলছিলেন।
মানুষের মাথার চেয়েও দুই হাত উঁচু প্রাণীটি বেশ শান্ত। গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় বাধা দেয়নি কোনোটি।
দুইটি উটই জাহাজে করে পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছে জানিয়ে বিক্রেতা বলেন, “গতবারও এনেছিলাম, সেগুলো বিক্রি হয়েছিল। এবার এই দুইটাও বিক্রি হবে আশা করি।”
গাবতলীতে হরিনাল জাতের একটি খাসির দাম উঠেছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। এছাড়াও একটি বড় ভেড়ার দাম হাঁকা হচ্ছিল এক লাখ টাকা।
টুকটাক বিক্রি শুরু
নাটোর থেকে আটটি গরু নিয়ে এসেছেন লিটন ভুঁইয়া। সবগুলো গরু নিজের বাড়িতেই লালন পালন করেছেন। তার মধ্যে মঙ্গলবারই দুটি বিক্রি হয়ে গেছে।
হাট থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনে হেঁটে হেঁটে নিয়ে যাচ্ছিলেন মো. আল আমিন। তিনি গাবতলীরই বাসিন্দা।
পশুটি আকারে খুব একটা বড় না। তবে ক্রেতা যে দামে কিনেছেন, তাতে তিনি অসন্তুষ্ট নন।
আল আমিন বলেন, “এই গরুর যে দাম তাতে আমরা খুশি। সকালে আরও দুইটা গরু কিনছি। প্রতিবার আমরা তিন থেকে চারটা করে গরু কোরবানি দেই। একটা বড় গরু কিনলে মাংস কম পাওয়া যায়। তাই কয়েকটা কিনি। ঈদ একটা উৎসব। তাই আত্মীয়-স্বজন ও গরিব মানুষদের সঙ্গে মাংস ভাগাভাগি করি।”
ভাটারা হাটের চিত্র
কুষ্টিয়া থেকে গুলশানের ভাটারা হাটে সোমবার নয়টি গরু নিয়ে এসেছেন মো. রমজান। সবগুলোই ষাঁড়।
তিনি বলেন, “আমরা চারজন এসেছি। তিনদিন ধরে গরুর পাশেই থাকছি। নিজেরা রান্না করে খাই।”
মেহেরপুর মুজিবনগর থেকে ১৬ টি গরু নিয়ে এসেছেন চান্দু মিয়াসহ ১১ জন। তিনি বলেন, “সোমবার আসছি, কারণ, একটু আগে এসে ভালো জায়গা দখল করতে হয়। এতদিন তেমন বেচাকেনা হয় নাই। কিন্তু আইজ অথবা কাল থেকে জমবে।”
এই হাটে দুইজন কর্মচারী সঙ্গে নিয়ে দুপুরে গরুকে গোসল করাচ্ছিলেন মো. আইনুল ব্যাপারী। তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে সাতটি গরু এনেছেন। সবচেয়ে বড়টির দাম চাইছেন সাড়ে আট লাখ টাকা।
এই হাটে এ নিয়ে টানা পঞ্চমবারের মতো গরু নিয়ে এসেছেন তিনি। বলেন, “এই হাটের পরিবেশ ভালো। গরুর গোবর এক জায়গায় আমরা জমা করি, ভলান্টিয়াররা কিছুক্ষণ পরপর এসে নিয়ে যায়।”
বিভিন্ন খামার থেকেও গরু আনা হয়েছে হাটগুলোতে। চোখে পড়েছে মুন্সি অ্যাগ্রো, বারিধারা অ্যাগ্রোর মত কয়েকটি খামারের ব্যানারও।
বারিধারা অ্যাগ্রো থেকে সোমবার আনা হয়েছে ৩২টি গরু। কয়েকটি বিক্রিও হয়ে গেছে। এগুলো বিক্রি শেষ হলে আরও আনা হবে বলে জানিয়েছে কর্মচারীরা।
হাটটির ইজারা নিয়েছেন ভাটারা থানা যুবলীগ নেতা মো. মিলন হোসেন। তার সঙ্গে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আরিফুর ইসলাম জুয়েল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জুয়েল বলেন, “আমাদের হাটের সুনাম রয়েছে, খামারিদের এখানে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় না।
“পাইকারদের মোবাইলে চার্জারের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মসজিদ, গোসলখানা, জাল টাকা পরীক্ষার মেশিন, পশুর ডাক্তার ও হাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও আমরা সচেতন।”
হাটটি বালুর মাঠের উপরে হওয়ায় বৃষ্টি হলেও পানি জমে না বা কাদা হয় না। এখানে খামারি বা বেপারীদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয় না। শুধু ক্রেতাদের থেকে শতকরা ৫ টাকা করে নেওয়া হয়।
হাটে দেখা গেল পশুর চিকিৎসক নাহিদ হাসানকেও। তিনি বলেন, “এমনিতে আমরা ফ্রিতে সেবা দিচ্ছি। তবে চিকিৎসা বেশ জটিল হলে কিছু চার্জ নেওয়া হয়, আর ওষুধের চার্জ নেওয়া হয়।”
এখন পর্যন্ত কোনো গরুর খুব বড় কোনো সমস্যা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “ছোটখাট যে সমস্যা হয়েছে সেসব চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটার চিকিৎসা চলমানও।”
আইনশৃঙ্খলা ঠিকঠাক রাখতে পুলিশ বাহিনী তৎপর আছে জানিয়ে ভাটারা থানা পুলিশের ওসি (পেট্রোল) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, “এতদিন তো তেমন ভিড় হয় নাই। আর বেচাকেনা খুব বেশি হয় নাই। আজ রাত বা কাল থেকে ভিড় হবে।
“কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আমরা সচেতন আছি। ক্রেতা-বিক্রেতা কাউকে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে বা ছিনতাই করে টাকা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যেন কেউ না করতে পারে, সে জন্য আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে।”
বনশ্রী-মেরাদিয়ায় দুর্ভোগের শঙ্কা
বনশ্রীর মেরাদিয়া হাটের জন্য আলাদা বা পরিত্যক্ত তেমন কোনো জায়গা নেই। তাই রাস্তার দুইপাশে পশু রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে রাস্তা কিছুটা সংকীর্ণ হওয়ায় গাড়ি যাতায়াতে যাত্রীদের ভোগান্তি পড়তে হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আকরাম হোসেন বললেন, “যানজট হয়। ঈদের আগে এটুকু আবার আমাদের উৎসবও। তবে যানজট যদি দীর্ঘায়িত হয়, তখন বিরক্তিও চলে আসে।”
এই হাটে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও খুব ভালো নয়।
রাজবাড়ী থেকে ১০ টি গরু নিয়ে সোমবার রাতে এসেছেন কামরুল ইসলাম। তিনি বিরক্তির সুরেই বললেন, “গরু দাঁড়ানোর জায়গায় যে বালি রয়েছে, এর নিচেই গোবর রেখে দেই। এগুলো ঈদের আগ মুহূর্তে হয়ত পরিষ্কার করবে।”
হাটের মাঝামাঝি এলাকায় লন্ডন টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় ইজারাদার আবু সাঈদের একটি অফিস খোলা হয়েছে। হাটের বিষয়ে বক্তব্য নিতে বেলা পৌনে তিনটার দিকে সেখানে গিয়ে তাকে বা অফিসের কাউকে পাওয়া যায়নি।