চাহিদা অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব ‘সোনালী ব্যাগ’ উৎপাদন না হওয়ায় ক্ষোভ এফবিসিসিআই সভাপতির।
Published : 08 Oct 2022, 08:08 PM
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাসাবাড়িতেই ময়লা থেকে প্লাস্টিক, মেটাল, কাগজ, মাথার চুল ইত্যাদি ধরন অনুযায়ী আলাদা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন, “আমরা জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের কথা বলি। আমি সেসব দেশের অলিগলিতে ঘুরছি, কোথাও ময়লা নাই, কারণ ইন্ডিভিজ্যুয়ালি তারা এটা (ময়লা আলাদা) করছে। ওসব দেশে হাউজ লেভেলে সেগ্রিগেশন করে…সেগ্রিগেশন যদি বাড়িতে করা যায়…কিন্তু হোম লেভেলে সেগ্রিগেশন সাকসেসফুল হচ্ছে না।”
শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে এফবিসিসিআই ও ইউনিলিভার বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘প্লাস্টিক বর্জ্যের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য নীতি সহায়তা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে উদ্ভাবনী ও কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, “বর্জ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াটি লাভজনক ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করা গেলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে টেকসই করা যাবে।”
অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, “বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর সাথে বহু অংশীজন ও খাত সম্পৃক্ত।”
প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গেজেটের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক বন্ধ করার জন্য একটি রোডম্যাপ অনুমোদন করেছে। বিশ্বের কোথাও আমাদের দেশের মতো প্লাস্টিক পলিথিন পড়ে থাকতে দেখা যায় না, তাই এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতার বিকল্প নেই।”
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টেকসই মডেল বাস্তবায়নে উৎসেই বিভিন্ন বর্জ্য আলাদা করা হলে সংগ্রহ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত প্রক্রিয়া সহজ হবে বলে মনে করেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
“ঢাকাতে বর্তমানে আমাদের পার ক্যাপিটা প্লাস্টিক কনজাম্পশন ১৩-১৫ কেজি। উন্নত দেশে ১০০ কেজির ওপর কনজাম্পশন, কিন্তু তারপরও ওরা জিরো ওয়েস্ট কান্ট্রি। এটা কিভাবে সম্ভব? কারণ ওরা ওয়েস্টকে ম্যানেজ করতে পারছে ঠিকভাবে। বাংলাদেশে আমরা ঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারছি না।
“তাই এটা ব্যান করি, এটা করি, ওটা করি। ২০০২ সালে পলিথিন বন্ধ করেছি। আমরা কি ব্যান করতে পারছি? এসব ব্যান না করে বরং ওরা কিভাবে ওয়েস্টটাকে ম্যানেজ করছে সেটা আমরা ফলো করলেই হয়।”
বর্জ্য থেকে যেসব প্লাস্টিক মিলছে তার পুনঃব্যবহারের পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমানে রাস্তা হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। ইন্ডিয়াতে বানাচ্ছে, পাকিস্তানে বানাচ্ছে।
“বাংলাদেশেও কয়েকটি টেস্ট রান চলছে। আমরা ইমোশনাল ডিসিশন বহু নিয়েছি, আল্টিমেটলি কিছু হয় না।”
অর্ধযুগ আগে পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প ‘সোনালী ব্যাগ’ তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোবারক আহমদ খান।
পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগের উৎপাদন এখনও ব্যাপক হারে শুরু না হওয়ায় বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন।
ইউনিলিভার বাংলাদেশের সিইও ও এমডি জাভেদ আখতার বলেন, “আমরা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সিটি কর্পোরেশনগুলোর সাথে বেশকিছু পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছি। একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠান এই সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। এজন্য পুরো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে এবং অবদান রাখতে হবে “
এ পর্যন্ত ইউনিলিভার বাংলাদেশ ১৬০০ টনের ওপর প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্লাস্টিক জীবন রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা হালকা আর সেজন্য এটা পরিবহনে জ্বালানি কম খরচ হয়।”
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও এফবিসিসিআইয়ের প্যানেল বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসাইন।
তিনিও প্লাস্টিকের ‘প্রয়োজনীয়তা’ তুলে ধরে বলেন, “যদি প্লাস্টিক এতই খারাপ হতো, স্যালাইন প্যাকগুলো প্লাস্টিকে হতো না। প্লাস্টিক না থাকলে কতগুলা গাছ কাটা হতো?
“আমি যদি কালেক্ট করতে পারি, ওয়েস্ট জেনারেশন প্রোবলেম না, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টে সমস্যা। প্লাস্টিক উৎপাদন করার পর তা ম্যানেজ করতে না করতে পারলে ডেঞ্জারাস।”
ড. ইজাজের কথায়, ঢাকা শহরে যত ময়লা উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে ১০ শতাংশ হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য। সেসব বর্জ্যের মাত্র ৩৬ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়, আর ল্যান্ডফিলে যায় ৩৯ শতাংশ বর্জ্য।
“অথচ ইউরোপে ল্যান্ডফিলে প্লাস্টিক যায় না। প্লাস্টিক ল্যান্ডফিলের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ল্যান্ডফিলে প্লাস্টিক পাঠিয়ে আমরা রিসোর্স ভ্যালু হারাচ্ছি। বাসায় কিন্তু খুব অল্প খাটনিতে ময়লাটা আলাদা করতে পারি আমরা।”
ল্যান্ডফিল ট্যাক্স চালুর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভাগুলোর কারিগরি ও আর্থিক সক্ষমতার অভাব মূল স্যমস্যা। এ কারণে সঠিক প্রক্রিয়ায় বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ ও উৎসে বর্জ্য পৃথক করা যাচ্ছে না, যা রিসাইকেলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।“
স্বল্পমেয়াদে ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি (এমআরএফ) স্থাপন করে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে সহজে ও কম খরচে বিকল্প জ্বালানি তেল (আরডিএফ) উৎপাদন করা সম্ভব বলেও জানান ড. ইজাজ হোসাইন।
সেমিনারে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিপিজিএমইএ’র সভাপতি শামীম আহমেদ, বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইউ জু এলিসন এল, এফবিসিসিআইয়ের প্যানেল উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সচিব জনাব ইকবাল হাবিব, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মইনুল ইসলাম, বাংলাদেশ পেট্রোকেমিকেল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও খাদেম মাহমুদ ইউসুফ। সঞ্চালনা করেন ইউনিলিভার বাংলাদেশের পরিচালক ও কর্পোরেট কমিউনিকেশন ও পার্টনারশিপ প্রধান শামীমা আক্তার।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই’র সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সহ-সভাপতি মো. সালাহউদ্দিন আলমগীর, মো. আমিন হেলালী, হাবীব উল্ল্যাহ ডন, মহাসচিব মোহাম্মদ মাহফুজুল হক।