‘পিশাচের পৃথিবীতে’ অনন্তের শেষ কথা

মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও অভিজিৎ রায়সহ অন্য ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ধরতে পুলিশের ব্যর্থতার সমালোচনায় মুখর ছিলেন অনন্ত বিজয় দাশ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2015, 01:41 PM
Updated : 12 May 2015, 02:50 PM

নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে প্রকাশ্যে চাবুক মারার হুমকি দেওয়ায় সিলেটের এক সাংসদকে কথার ‘চাবুকে’ও ক্ষতবিক্ষত করেছেন এই ব্লগার।

মঙ্গলবার সকালে সিলেটের সুবিদবাজারের বনকলাপাড়া থেকে রিকশায় করে শহরের দিকে যাওয়ার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অনন্তকে। আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা এই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব ইতোমধ্যে স্বীকার করেছে।

সোমবারও এক স্ট্যাটাসে অভিজিৎ রায় ও ওয়াশিকুর রহমান বাবুর খুনিদের ধরতে না পারায় পুলিশের সমালোচনা করেন অনন্ত।

“অভিজিৎ রায়কে যখন খুন করা হয়, অদূরেই পুলিশ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছিল। খুনিরা নিশ্চিন্তে খুন করে চলে গেল। পরে পুলিশ বলে তাদের নাকি দায়িত্বে অবহেলা ছিল না। বড় জানতে ইচ্ছে করে তাদের দায়িত্বটা আসলে কী!”

“ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে যখন খুন করে খুনিরা পালিয়ে যাচ্ছিল, তখনও কিন্তু পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু পুলিশের কপাল খারাপ, তারা বলতে পারলে না, এক্ষেত্রেও তাদের কোনো দায়িত্বে অবহেলা ছিল না। কারণ, লাবণ্য নামের তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানবিক মানুষ খুনিদের ধরে ফেলেন। খুনিদের শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেন।”

 

মুক্তমনা ব্লগসাইটে নিয়মিত লিখতেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র অনন্ত। এই ব্লগসাইটটি পরিচালনা করতেন অভিজিৎ রায়।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের দেড় মাসের মধ্যে ঢাকার তেজগাঁওয়ে খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। ওয়াশিকুর ও অভিজিতের মতো কায়দায় হত্যা করা হয় অনন্তকে।

বর্ষবরণ উৎসবে যৌন হয়রানিতে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়নের বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিপেটার সমালোচনাও ফেইসবুকে করেছিলেন অনন্ত।

মুক্তমনায় লেখার পাশাপাশি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগসহ অনলাইনে অনন্ত সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও যুক্তিনির্ভর লেখালেখি করতেন। ২০০৬ সালে তিনি মুক্তমনা র‌্যাশনালিস্ট অ্যাওয়ার্ড পান।

অনন্ত বিজয় সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘যুক্তি’ সম্পাদনা করতেন। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়’, ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ’, ‘ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’ শিরোনামে তিনটি বইও রয়েছে তার।

মুক্তমনা ব্লগে তার লেখাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ফারাবীর ফাতরামি’; জামায়াতের রাজনীতি কি নিষিদ্ধ হবে?’।

বেসরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত অনন্তের সবশেষ পোস্টটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে চাবুক মারার হুমকি দেওয়া সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ সামাদ চৌধুরীকে ইঙ্গিত করে লেখা।

গত শনিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ফেঞ্চুগঞ্জে একটি অনুষ্ঠানে সাংসদ সামাদ চৌধুরী শিক্ষক জাফর ইকবালকে ‘সিলেটবিদ্বেষী’ আখ্যায়িত করে বলেন, “আমি যদি বড় কিছু হতাম তাহলে জাফর ইকবালকে কোর্ট পয়েটে ধরে এনে চাবুক মারতাম।”

শিক্ষকের অপমানে ক্ষুব্ধ অনন্ত সরকারদলীয় এই সাংসদকে কটাক্ষ করে লিখেছেন, “সাংসদের চাবুক মারার কথা শুনে আমারও অধ্যাপক আজাদের মতো জানতে ইচ্ছে করে, আপনি কী পাস সেটা এখন আর জানার দরকার নেই, আপনি কী ফেল সেটাই না হয় বলুন! মেধা-গুণ-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো দিক দিয়ে যে অধ্যাপকের হাঁটুর কাছে বসার যোগ্যতা এদের নেই তারাই আবার ওই অধ্যাপককে চাবুক মারার কথা বলে! কলিকালের শিক্ষা একেই বলে!”

পোস্টের একটি অংশে মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্যের বাবার বিতর্কিত ভূমিকা নিয়েও বলেছেন অনন্ত।

হত্যাকাণ্ডের পর অনন্তের ফেইসবুক স্ট্যাটাসে মন্তব্য লিখে শোক, ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকেই।

একজন লিখেছেন, “প্রায় ৩ ঘণ্টা আগেও আপনার স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিলাম দাদা। ভুলেও ভাবিনি এটাই আপনার শেষ স্ট্যাটাস!”

আরেকজন লিখেছেন, “দাদা, সত্যিই আমি বাকরুদ্ধ। তোমাকেও হারাতে হল? আমারা লজ্জিত তোমার কাছে।”

“দাদা, ভালোই হলো- চলে গেলেন। পিশাচের পৃথিবীতে মানুষের থাকা উচিত না,” লিখেছেন অনন্তের আরেক ফেইসবুক বন্ধু।