হেফাজতবিরোধী মতিঝিল অভিযান নিয়ে তথ্য বিকৃতির অভিযোগে সাধারণ ডায়েরির তদন্ত শেষে অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান শুভ্র ও পরিচালক নাসিরুদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে আদালতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দাখিল করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
Published : 04 Sep 2013, 04:01 PM
এতে বলা হয়, সাধারণ ডায়েরিতে তাদের বিরুদ্ধে তথ্য বিকৃতি করা, মতিঝিল অভিযান নিয়ে অসত্য তথ্য উপস্থাপন, ফটোশপের মাধ্যমে ছবি বিকৃত করে অধিকারের প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা এবং জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানোর মতো যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক ছিল।
গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম বুধবার এই অভিযোগ মহানগর হাকিম আদালতে দাখিল করেন বলে আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক কুতুবুল আলম জানান।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার মহানগর হাকিম জয়নব বেগমের আদালতে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।
তবে তথ্য প্রযুক্তি আইনের অভিযোগ হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতার শুনানি হবে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে।আদালত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করলে ওই সাধারণ ডায়রির ভিত্তিতেই আদিল ও এলানের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শুরু হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, গত ৫ মে মতিঝিলে পুলিশের ওই অভিযানের রাতে কেউ নিহত হয়নি বলে তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, অধিকার যে ৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে সেই তালিকা জব্দ করা কম্পিউটার থেকে পাওয়া গেছে। এই তালিকা নিয়ে তদন্তে দেখা গেছে পাঁচজনের নাম দুইবার করে এসেছে। চারজন নারায়ণগঞ্জ এবং দুইজন চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে পরের দিন গণ্ডগোলে মারা গেছেন।
“একজন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। নাম আছে ঠিকানা নাই ১১ জনের। নাম এবং ঠিকানা ভুয়া সাত জনের। ১০ ক্রমিকে কারো নাম উল্লেখ নাই। এ ছাড়া চারজন জীবি আছেন, তাদের মধ্যে কেউ জেলখানায় কেউ মাদ্রাসায় আবার কেউ চাকরি করছে।”
যুগ্ম কমিশনার জানান, ৬১ জনের মধ্যে এ হিসাবে ৩৫ জনের নাম বাদ দিলে যে ২৬ জন থাকে তারা মারা গেছেন ঠিকই। কিন্তু শাপলা চত্বরের পুলিশের অভিযানে মারা যাওয়ার কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আর এই ২৬জনের মধ্যে অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মী, অফিস কর্মচারী, পথচারি, পরিবহন শ্রমিক রয়েছেও বলে জানান তিনি।
শাপলা চত্বর থেকে পাওয়া যাওয়া চারজনের লাশ দিনে অন্য স্থানে মারা গিয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, ওই চারটি লাশ ছাড়া শাপলা চত্বরে আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি।
মনিরুল জানান, ৫ মে হেফাজতের সাথে বিক্ষোভের সময় সরকারের পক্ষ থেকে যে ১৩ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেই ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনের নাম অধিকারে তালিকায় রয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তার নাম তালিকায় নাই। ২৬ জনের মধ্যে বাকি ১৪ জন শাপলা চত্বরের বাইরে রাস্তাসহ বিভিন্ন জায়গায় মারা গেছে।
এই তালিকার ১ নম্বরে সিদ্দিকুর রহমান নামে একজনের নাম উল্লেখ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই সিদ্দিক পুলিশের রিকুজিশন করা গাড়ি চালক। ৫ মে দুপুরে বায়তুল মোকাররম এলাকায় হেফাজতে ইসলামের হামলায় মারা যান।
অধিকারের প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ করা হয়নি বলে জানান মনিরুল ইসলাম।
তাছাড়া ৫ মে হেফাজতে ইসলামের হামলার শিকার হয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা মারা গেলেও অধিকারের তালিকায় তার নাম নেই।
মনিরুল জানান, অধিকারের প্রতিবেদন ছিল একপেশে। কেননা হেফাজত কর্মীরা ৫ মে দিনব্যাপী যে তাণ্ডব চালিয়েছে প্রতিবেদনে তার কোন বর্ণনাই নাই।
অধিকারের প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ বন্ধ করে অভিযান চালানোর কথা বলা হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা নাকচ করেছে বলে জানান তিনি।
এদিকে অধিকারের দুইজনকে আসামি করে যে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে এই অভিযোগের মধ্যে তথ্য প্রযুক্তি আইনের সব্বোর্চ সাজা ১০ বছর এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির আইনের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর।
আদিল এবং এলানের বিরুদ্ধে আদালতে দায়ের করা প্রতিবেদনে ৩২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে আদিলের স্ত্রী ও বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধি রয়েছেন।
ওই রাতে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে অভিযান চালায়, তাতে ৬১ জন নিহত হয় বলে ডানপন্থীদের সমর্থনপুষ্ট অধিকারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অধিকারের কাছে ‘নিহত’ ৬১ জনের নাম পরিচয় চেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হলেও অধিকার তথ্য দিতে অস্বীকার করে।
এরপর গত ১০ অগাস্ট আদিলকে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন।
আদিলকে গ্রেপ্তার করায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়; বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও নিন্দা জানায়।
নিম্ন আদালত আদিলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৫ দিনের রিমান্ডে নিতে অনুমতি দিলেও হাই কোর্টের এক আদেশে রিমান্ড স্থগিত করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আর অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান পলাতক বলে যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান।
পুলিশের অভিযোগপত্রে বলা হয়, আদিল ও এলান ৬১ জনের মৃত্যুর ‘বানোয়াট, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও মিথ্য’ তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নের অপচেষ্টা চালায় এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দেশে বিদেশে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করে।পাশাপাশি তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করে, যা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ও (২) ধারায় অপরাধ।
“একইভাবে ওই আসামিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর টেষ্টা চালায় এবং সরকারকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালায় যা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫০৫ ‘সি’ ও ‘ডি’ এবং ৫০৫ ‘এ’ ধারায় অপরাধ।”
মনিরুল ইসলাম জানান, পুলিশের প্রতিবেদনে নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়েছে।এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৩২ জনকে।
হেফাজতবিরোধী অভিযানে ‘নিহতের’ সংখ্যা নিয়ে চাপের মধ্যে থাকা মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের একটি অভিযোগেরও তদন্ত শুরু করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা একটি অভিযোগ পান, যাতে বলা হয়, মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আসা কোটি কোটি টাকা ভুয়া খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছে অধিকার।