ডেসটিনি: সাবেক সেনাপ্রধান হারুনের সাজা যে কারণে কম

গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের দায়ে ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনকে ১২ বছর সাজা দেওয়া হলেও কোম্পানির প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের’ কথা বিবেচনায় নিয়ে।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2022, 05:34 PM
Updated : 12 May 2022, 05:34 PM

ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম বৃহস্পতিবার এই রায়ে ৪৬ আসামির সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা জরিমানা করেছেন।

ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটির প্রায় ১ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই কলাবাগান থানায় এ মামলা করে দুদক। ২০১৬ সালের ২৪ অগাস্টে অভিযোগ গঠন করে আদালত আসামিদের বিচার শুরুর আদেশ দেয়।

গত কয়েক দশকে বড় যে কটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা দেশকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে, ডেসটিনির অর্থ আত্মসাৎ তার একটি।

ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ

২০০০ সালে ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড নামে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি দিয়ে এই গ্রুপের যাত্রা শুরু। পরের বছরে বিমান পরিবহন, আবাসন, মিডিয়া, পাটকল, কোল্ড স্টোরেজ, বনায়নসহ বিভিন্ন খাতে ৩৪টি কোম্পানিতে ডেসটিনির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। 

পরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে চার হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে এ কোম্পানির বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের নামে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল ডেসটিনি। সেখান থেকে ১ হাজার ৮৬১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। তাতে সাড়ে ৮ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়েন।

আইন অনুযায়ী অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ বছরের কারাদণ্ড। ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীনকে সেই দণ্ডই দিয়েছে আদালত। পাশাপাশি তাকে ২০০ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৩ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে রায়ে।

আর ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশীদকে চার বছরের কারাদণ্ড এবং সাড়ে ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। চার বছরের দণ্ড এ আইনে সর্বনিম্ন সাজা।

হারুনকে কম সাজা দেওয়ার ব্যাখ্যায় বিচারক তার রায়ে বলেন, “হারুন-অর-রশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের কারণে তাকে সর্বনিম্ন দণ্ডে দণ্ডিত করা হল।”

হারুনের অবরুদ্ধ সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাবে অবমুক্ত (রিলিজ) করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে। তবে জরিমানার তিন কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা তাকে পরিশোধ করতে হবে।

ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ

৭৪ বছর বয়সী হারুনের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারীর ধলই ইউনিয়নে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়।

২০০০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আসেন হারুন। ২০০২ সালের জুনে অবসরে যাওয়ার পর সরকার তাকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ফিজির রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও দিয়েছিল। 

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাবেক মহাসচিব হারুন-অর-রশিদ ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন ২০০৬ সালে। পরের কয়েক বছরে আরও বহু ক্ষেত্রে ডেসটিনির ব্যবসা বিস্তৃত হতে দেখা যায়।

কিন্তু জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ এবং ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ তুঙ্গে উঠলে ২০১২ সালে হারুন ও রফিকুল আমীনকে কারাগারে যেতে হয়।

পরে ‘স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবস্থা’ বিবেচনায় হারুন জামিন পেলেও রফিকুল আমীন কারাগারেই ছিলেন। বৃহস্পতিবার রায়ের পর হারুনকেও সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত।  

পরে রাতে খবর আসে, হৃদরোগের কারণে তাকে কারা তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। 

সাবেক সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের পর হারুন-অর-রশিদই প্রথম সাবেক সোনপ্রধান, যাকে কোনো মামলায় দণ্ড নিয়ে কারাগারে যেতে হল।