স্বস্তির ঈদযাত্রায় দুই চাকার জোয়ার

এবারের ঈদযাত্রায় দূরপাল্লার বড় যানের পাশাপাশি সাই সাই ছুটেছে মোটরসাইকেলও; উত্তরের পথে বঙ্গবন্ধু সেতুর অবাক করা হিসাব আর দক্ষিণে ফেরি ঘাটের চিত্র বলছে, দু’চাকার এ বাহন মহাসড়ক দাপিয়েছে দিনের বড় অংশজুড়েই।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 April 2022, 08:28 PM
Updated : 29 April 2022, 08:33 PM

শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি দিয়ে ঈদের বন্ধ শুরুর প্রথম দিন ঢাকা ছাড়ার প্রবেশ পথেও দিনভর দেখা গেছে মোটরবাইকের আধিক্য, যাতে করে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে চালকসহ এক কখনওবা একাধিক যাত্রীকে।

কোভিড মহামারীর বিধিনিষেধ ছাড়া দুই বছর পরের এবারের ঈদযাত্রায় সড়কে অনেকটা যানজটবিহীন স্বস্তির যাত্রার এদিনে মোটরসাইকেলের সংখ্যাধিক্য ভিন্নভাবে নজর কেড়েছে।

গাড়ির চাপ থাকলেও সড়কে বরাবরের মত অসহনীয় জট আর দীর্ঘ বিলম্ব না থাকায় ছুটি শুরুর প্রথম দিনের ঈদযাত্রায় আলোচনায় এসেছে মহাসড়কে মোটরসাইকেলের বহরের নানান চিত্র।

রাজধানী ঢাকা ছেড়ে কাছের দূরত্বে তো বটেই উত্তর কিংবা দক্ষিণের পথেও দুই চাকার বাহনকে ছুটতে দেখা গেছে দিনভরই। অনেকে বলছেন, রাতেও বাইকে করে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে অনেককে।

সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, স্কুল-কলেজে ছুটি শুরুর পরই প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনে অনেকেই আগে ঢাকা ছেড়েছেন। আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর এবার কোভিড মহামারীর দুই বছর বিরতির পর ঈদের আগে ‘সড়কে কী না কী হয়’ এমন আশঙ্কায় একটি অংশ আগেই ঢাকা ছেড়েছেন।

এরই সুফল দেখা গেছে আনুষ্ঠানিক ছুটি শুরুর প্রথম দিন শুক্রবার; ট্রেন বা বাসে ভিড় থাকলেও আগের সেই অসহনীয় অবস্থার দেখা মেলিনি। ভোগান্তি যা ছিল বৈশাখের খরতাপে, ভ্যাপসা গরমে।

আর বিকল্প বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের দাপটকে অনেকেই এবারের ঈদযাত্রার বিপ্লব হিসেবে দেখছেন, যা চাপ কমিয়েছে গণপরিবহনে। এবার দুই চাকার এ বাহনে করে দূরের পথেও পাড়ি দিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

বুধবার থেকে বাস, ট্রেনের ঈদযাত্রা শুরু হলেও যাত্রীদের ভিড় শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে। ঘরমুখো মানুষের ঢল বৃহস্পতিবার রাত পেরিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত দেখা গেছে। তবে শুক্রবার দুপুরের পর থেকে বাসে যাত্রীদের ভিড় কমে আসে।

এবার ঈদ উল ফিতরের সম্ভাব্য দিন সোম। সে হিসাবে ঈদের আগে বাড়ি ফেরার জন্য তিনদিন ছুটি মিলেছে। বাড়তি দুই দিন সময় পাওয়ায় সড়কে চাপ কমেছে; যা ভোগান্তিও কমিয়েছে কিছুটা।

দুই চাকায় দূরের পথে

রাজধানীর মহাখালী এলাকার একটি বায়িং হাউজের কর্মকর্তা আহমেদ আলী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে যাচ্ছেন বাইকে করে; দুপাশে বাঁধা দুটো ব্যাগ।

শুক্রবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের গাউসিয়া এলাকায় কথা হলে তিনি বলেন, “আমরা দুজন মাত্র মানুষ। যে প্রচণ্ড গরম, বাসের চেয়ে মোটরসাইকেলেই ভালো। হাওয়া খেতে খেতে চলে যাওয়া যাবে। তবে সিলেট মহাসড়কে প্রচুর বাস, এজন্য আমরা হাইওয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।”

তাদের মত রাজধানীতে বাইক চালানো অনেকেই আগের তিক্ত অভিজ্ঞতায় কিছুটা ঝুঁকির পরও সড়কের যন্ত্রণা এড়াতে বেছে নিয়েছেন এমন পথ। যে কারণে ঈদযাত্রায় আগের সময়ের তুলনায় বেড়েছে মোটরসাইকেলের চলাচল।

বঙ্গবন্ধু সেতু, মাওয়া ও পাটুরিয়া ঘাট হয়ে বাইকে চড়ে বাড়ির পথে যেতে দেখা গেছে হাজার হাজার মানুষকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও চোখে পড়ার মত ছিল মোটরসাইকেলের ভিড়।

বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে মোটরবাইক পার হওয়ার অবাক হওয়ার মত তথ্য মিলেছে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে শুক্রবার রাত ১০টা পর্যন্ত ২২ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে ৩৯ হাজার ২৫৫টি যানবাহন পার হয়েছে। এরমধ্যে মোটরসাইকেলই ছিল ৭ হাজার ৮৬২টি।

এগুলোর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের দিকে গেছে ৬ হাজার ৬৮৫টি বাইক বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু সেতুর ভূঁয়াপুর সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) আহসান মাসুদ বাপ্পী। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে।

“গত বছর একদিনে ১২ হাজারের মত বাইক সেতু পার হয়েছিল। কিন্তু সে সময় করোনাভাইরাস মহামারী পরিস্থিতিতে যানবাহনের চলাচলে বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু এবার তা নেই, বাসও চলছে, পাশাপাশি প্রচুর বাইকেও মানুষ যাচ্ছে।”

দক্ষিণের পথে যাত্রায় কয়েকটিতে ফেরিতে দেখা গেছে বেশির ভাগই মোটরসাইকেল; গাড়ির সংখ্যা হাতে গোনা। আর একটি ফেরির ছবিতে দেখা গেছে শুধু মোটরসাইকেল, এমনকি প্রাইভেট কারও চোখে পড়েনি।

শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই গাবতলীতে বাসগুলো ফাঁকা থাকা আর বাসকর্মীদের যাত্রী ডাকতে দেখা যাওয়ার এটি উল্লেখযোগ্য কারণ বলছেন অনেকেই।

সকালে ভিড় ছিল ট্রেনে, দেরির সমস্যা কেটেছে

আগের দুদিনের তুলনায় শুক্রবার সকালে ঘরমুখো যাত্রীর চাপ আরও বাড়তে দেখা যায় ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। তবে এদিন সময়মতো ট্রেন ছাড়তে না পারার সমস্যা কাটিয়ে ওঠায় সেই চাপ ভালোই সামলেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

এদিন শুধু চারটি আন্তঃনগর ট্রেন নির্ধারিত সময়ের পরে ছাড়তে দেখা যায়। চিলাহাটি রুটের নীলসাগর এক্সপ্রেস এক ঘণ্টা ১০ মিনিট, রংপুর এক্সপ্রেস ১৫ মিনিট, সুন্দরবন এক্সপ্রেস এক ঘণ্টা ৩০ মিনিট এবং চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেন ৪০ মিনিট দেরিতে ছাড়ে। বাকিগুলো সূচি অনুযায়ী চলায় স্বস্তি ছিল সবার মধ্যেই।

সুন্দরবন এক্সপ্রেসের যাত্রী শামীম হাসান বলেন, সকালে প্রায় এক ঘণ্টা আগে এসেছেন। কিন্তু ট্রেন ছাড়তে দেরি করেছে। ঈদের সময় এ সমস্যা সব সময় হয়। গরমে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে কষ্ট হয়েছে।

রেলওয়ের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা আমিনুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সারাদিনে ৬১টি ট্রেন কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। বেশিরভাগ ট্রেনই চলে গেছে।

“প্রথম দুদিনের তুলনায় শুক্রবার ট্রেনের সময়সূচী বিড়ম্বনা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে। যেসব ট্রেন ঢাকায় আসছে সেগুলোকে সিগন্যালে প্রায়োরিটি দেওয়া হয়েছে। অন্য ট্রেনগুলো দাঁড় করিয়ে ঢাকামুখী ট্রেনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে সময়সূচী ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে।”

বাসে ভিড় নেই

শুক্রবার দুপুরের পর থেকে ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোয় যাত্রীদের চাপ কমে আসে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, লম্বা ছুটিতে বেশির ভাগ মানুষ আগেভাগে ঢাকা ছাড়ায় এমনটি হয়েছে।

এদিন বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত গাবতলী টার্মিনাল এলাকায় ভিড়ভাট্টা তেমন দেখা গেল না। টার্মিনালের সামনে সারি করে রাখা ছিল সেলফী পরিবহনের অনেকগুলো বাস। দুজন কর্মী ‘ঘাট দুইশ’ বলে চিৎকার করে যাত্রীও জড়ো করছেন।

শুক্রবার বিকেলের গাবতলীর সড়ক দেখে বোঝার উপায় নেই ঈদ ঘনিয়ে আসছে

একটু সামনেই পদ্মা দ্রুতগামী পরিবহনের বাসটি ছেড়ে ‘যাব যাব’ করছে, তখনও চালকের সহকারী যাত্রী টানার চেষ্টা করছেন। অথচ আগের বছরগুলো যা ছিল কল্পনারও অতীত।

এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সেলফী পরিবহনের কর্মী বিপ্লব দাস বলেন, “ঈদের টাইমে এবার যাত্রী ডাইকা আনা লাগতাছে। অন্যবার গাড়ি টার্মিনালে লাগার লগে লগে ভইরা যায়। এইবার লোকজন যাইতাছে ধীরে সুস্থে।”

বাসে যাত্রী কম থাকার কথা জানালেন মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালামও।

শুক্রবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসের অনেক আসন ফাঁকা থাকছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে যাত্রীরা রাস্তায় আসছে না বলে তার ধারণা।

ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে শুক্রবার সকালে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ঘরমুখো মানুষের ভিড়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

“আমাদের টার্মিনাল থেকে যত গাড়ি যায় তার মধ্যে ৩০ শতাংশ গাড়ি রাস্তায় নামতে পারে নাই। কারণ যাত্রী নাই। ঈদের ছুটিতে স্রোতের মতো মানুষ আসে টার্মিনালে। বৃহস্পতিবার সবচেয়ে বেশি ভিড় হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তেমন মানুষ আসেনি,” যোগ করেন তিনি।

‘কিছুটা’ চাপ বেড়েছে সদরঘাটে

শুক্রবার সকালে কিছু যাত্রী সদরঘাটে আসলেও দুপুরে পন্টুন ছিল ফাঁকা। বিকালের পর যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।

আর গরমের কারণে কালবৈশাখীর শঙ্কার মধ্যেও প্রায় প্রতিটি লঞ্চের ছাদে দেখা গেছে যাত্রী। তবে ছাদে যাত্রীর উঠানোর অপরাধে চার লঞ্চকে জরিমানাও করেছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

বিআইডব্লিউটিএ এর পরিবহন পরিদর্শক এবিএস মাহমুদ বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ৯৬টি লঞ্চ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। এদিন ১৩০টি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা। বৃহস্পতিবার এ সংখ্যা ছিল ১১০টি লঞ্চ।