রেইনট্রি মামলায় পিয়াসার হাত দেখছেন বিচারক

ঢাকার বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলার পেছনে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার ভূমিকা দেখছে আদালত।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2021, 06:00 PM
Updated : 12 Nov 2021, 03:32 AM

ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার বৃহস্পতিবার এ মামলার রায়ে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছেন।

রায় ঘোষণার সময় দেওয়া বক্তব্যে বিচারক বলেন, “তারা ধর্ষণের শিকার হয়নি। সাফাতের সদ্য ডিভোর্সপ্রাপ্ত স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার প্ররোচনায় এই মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।”

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ করা হয় এ মামলায়।

সাফাত আহমেদ, তার বন্ধু সাদমান সাকিফ ও নাঈম আশরাফ, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লালকে সেখানে আসামি করা হয়।

ঘটনার এক মাসের বেশি সময় পর ৬ মে বনানী থানায় মামলাটি করেন এক তরুণী। তার অভিযোগ ছিল, ওই হোটেলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাকেসহ তার বন্ধুকে রাতভর আটকে রেখে সাফাত ও নাঈম ধর্ষণ করেন। অন্য তিনজন তাতে সহায়তা করেন।

সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সাফাত ও নাঈম আশরাফ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। 

পরের মাসে ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি। অভিযোগ গঠনের পর জুলাই মাসে বিচার শুরু করে আদালত।

বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার আগে বিচারক বলেন, “আপনারা এই মামলাকে আলোচিত বলেন। আমি অবশ্য তেমনটা মনে করি না। আদালতের কাছে সব মামলাই সমান।”

এরপর তিনি একে একে এজাহার, ভুক্তভোগীর জবানবন্দি, সাক্ষীদের জবানবন্দি, মেডিকেল রিপোর্ট, আসামিদের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দির বর্ণনা দেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডা. সোহেল মাহমুদের মেডিকেল রিপোর্টের বরাতে বিচারক বলেন, সেখানে বলপূর্বক যৌন সম্পর্কের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে অভিযোগকারীরা যৌনসঙ্গমে অভ্যস্ত। ফলে অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে।

সাফাতের সাবেক স্ত্রী পিয়াসার মাধ্যমে ‘প্রভাবিত হয়ে’ এ মামলা করা হয়েছে- এমন ধারণা প্রকাশ করে বিচারক বলেন, “ঘটনার পরদিন মামলা হওয়ার আগে থেকেই পিয়াসা থানায় গিয়ে বসে ছিলেন। ভুক্তভোগীরা জানান, পিয়াসা যে সাফাতের সাবেক স্ত্রী, একথা তারা জানতেন না। তবে তিনি সাফাতের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলেছিলেন। পিয়াসা যে সাফাতের সাবেক স্ত্রী এ কথা তারা পরে জেনেছেন।” 

ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হওয়ার সময় সাফাত আহমেদদের হাস্যোজ্জ্বল মুখই বলে দিচ্ছে তিনি খালাস পেয়েছেন। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের আলোচিত মামলাটিতে তিনিসহ সব আসামিই খালাস পেয়েছেন। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সাফাতের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার কয়েক মাস আগে পিয়াসার সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। মামলা দায়েরের সময় অভিযোগকারী এক তরুণীর সঙ্গে ছিলেন পিয়াসা। এ মামলায় সাক্ষী করা হলেও তিনি আদালতে গিয়ে জবানবন্দি দেননি। 

মডেল পিয়াসা সম্প্রতি মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন। সাবেক শ্বশুর আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের সঙ্গে তার পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছিল।

সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জেরার বর্ণনায় বিচারক বলেন, এ ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষে প্রথম পর্যায়ের পাঁচজন সাক্ষী ছিলেন রেইনন্ট্রি হোটেলের কর্মচারী। তারা আদালতে সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ওইদিন রাতে বিভিন্ন সময়ে তারা হোটেলে ডিউটিতে ছিলেন। তবে সেখানে কোনো ধর্ষণ বা অপ্রীতিকর ঘটনা তারা ‘শোনেননি বা দেখেননি’।

সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলীর জবানবন্দি পড়ে শুনিয়ে বিচারক বলেন, “সেখানে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কিন্তু সেটা ধর্ষণ নয়। আর ওই হোটেলে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যায় না বলে কর্মচারীরা সাক্ষ্যে বলেন। সুতরাং অস্ত্রের মুখে কীভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটল?”

রিমান্ডে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ করে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলেন আসামিরা। সে কথা তুলে ধরে বিচারক বলেন, ‘পারিপার্শ্বিক বিবেচনায়’ তা সঠিক মনে হওয়ায় ওই জবানবন্দিকে তিনি সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করছেন না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারার ব্যাখ্যা করে বিচারক বলেন, সেখানে ধর্ষণের তিনটি উপাদানের কথা বলা হয়েছে। সম্মতি ব্যতিরেকে, ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলক সম্মতি আদায়- এই তিন উপাদানের কোনোটি তিনি এ মামলায় পাননি।

“ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা হল, চিকিৎসক মেডিক্যাল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাননি মর্মে মতামত দিলেন, ভুক্তভোগীদের পরিধেয় কাপড়ে কোনো পুরুষের সিমেন্সের কনা পাওয়া যায় নাই…। তারপরও তদন্ত চার্জশিট দাখিল করে আদালতের পাবলিক টাইম নষ্ট করেছেন।

“এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেইপ কেসের বিচার ব্যাহত হয়েছে। তিনি অন্য কোনো পক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এই চার্জশিট দিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। আজকের দিনসহ এই মামলায় ৯৪ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে।”

৭২ ঘণ্টার পর মেডিকেল পরীক্ষা করা হলে যে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না, সে কথা তুলে ধরে বিচারক পুলিশকে ওই সময়ের পরে কোনো মামলা নিতে নিরুৎসাহিত করেন, কারণ তাতে মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

রায়ে বিচারক বলেন, “পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় এই মামলা সাজা হওয়ার মতো নয়। প্রসিকিউশন এই মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। তাই আসামিদের উক্ত অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হল।”