শিক্ষা মন্ত্রণালয় টিকা দেওয়ার জন্য ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের তালিকা তৈরি করেছে। সেই তালিকা ধরে নিবন্ধনের কাজটি এগিয়ে নিচ্ছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। আসছে ১ নভেম্বর থেকেই স্কুলের ছেলেমেয়েদের টিকা দেওয়া হবে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইতোমধ্যে জানিয়েছেন।
গত ১৪ অক্টোবর মানিকগঞ্জের কয়েকটি স্কুলের ১২০ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়। পরের ১৪ দিন পর্যবেক্ষণ করে তাদের কারও কোনো সমস্যা দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেকের তৈরি করা এই টিকা ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের শরীরে প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে। বড়দের মত মত শিশুদের জন্যও প্রতিটি ডোজের পরিমাণ ঠিক করা হয়েছে ৩০ মাইক্রোগ্রাম।
এসব দেশে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের দেওয়া হচ্ছে ফাইজারের টিকার ১০ মাইক্রোগ্রামের দুটি ডোজ, যা ১২ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য ডোজের এক তৃতীয়াংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকি কমিয়ে আনতেই শিশুদের জন্য ফাইজারের টিকার ডোজ ছোট করে আনা হয়েছে।
ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্যাথরিন এম এডওয়ার্ড নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, “আমরা সব সময় সবচেয়ে কম পরিমাণ ভ্যাকসিন প্রয়োগের পক্ষপাতী, কারণ তাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিও কমে আসে।”
ফাইজার-বায়োএনটেক বলেছে, ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী ২ হাজার ২৬০ জন কিশোর-কিশোরীর ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছিল তারা। সেখানে একটি গ্রুপকে আসল টিকা আর বাকিদের শুধু লবণপানির ‘প্লাসেবো’ দেওয়া হয়েছিল।
দেখা গেছে, প্লাসেবো পাওয়া গ্রুপের মধ্যে ১৮ জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু টিকা পাওয়া কেউ আক্রান্ত হয়নি। অর্থাৎ, ওই গবেষণায় শতভাগ কার্যকারিতা দেখিয়েছে ফাইজারের টিকা।
বিশ্বে করোনাভাইরাসের মহামারী শুরুর পর মোটামুটি এক বছরের মধ্যে টিকা উদ্ভাবন সম্ভব হওয়ায় আশার আলো জাগে চলতি বছরের শুরুতে। কিন্তু প্রথম দিকে যেসব টিকা বাজারে এসেছে, তার সবগুলোই কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছিল, কারণ শিশুদের ওপর এসব টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল তখনও হয়নি।
হার্ড ইমিউনিটির ধারণার মূল শর্তই হল মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগের শরীরে একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে হবে। অর্থাৎ, ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও তারা আক্রান্ত হবেন না।
শিশুদের এই টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার কারণ হল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এখনও হৃদযন্ত্রের প্রদাহের (মায়োকার্ডাইটিস) সঙ্গে এমআরএনএ টিকার যোগাযোগ বোঝার চেষ্টা করছেন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। ফাইজারের মত মডার্নার টিকাও এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি।
এমনিতে সাধারণভাবে করোনাভাইরাসে শিশুদের মৃত্যুর হার বড়দের তুলনায় অনেক কম। তবে আক্রান্ত কারও কারও মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী কিছু জটিলতা দেখা যায়, যা এখনও গবেষণার বিষয়। কোভিড-১৯ এর কারণেও কিশোর-তরুণদের মধ্যে মধ্যে হৃদযন্ত্রের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পর্যাপ্ততা আর ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ শিশুদের ফাইজারের টিকার একটি ডোজ দেওয়ার পক্ষে। অনেকে আবার মনে করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে বাংলাদেশেও শিশুদের ফাইজারের টিকার দুটি ডোজই দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বলেছে, শিশুদের করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনই অনুসরণ করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলছে?
কোভিড আক্রান্ত হলে শিশু কিশোরদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতা দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম। সে কারণে গুরুতর কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা না থাকলে শিশুদের কোভিড টিকা দেওয়ার বিষয়ে বয়স্কদের তুলনায় কম জোর দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এ সংস্থার স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ সিদ্ধান্ত দিয়েছে, ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা ১২ বছর থেকে বেশি বয়সী সবার জন্যই উপযোগী।
তবে শিশুদের কোভিড টিকা দেওয়ার বিষয়ে সাধারণ একটি নীতিমালা দেওয়ার আগে বাজারে থাকা অন্যান্য টিকা নিয়ে আরও গবেষণা ও তথ্যপ্রমাণের প্রয়োজন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
আরও কয়েকটি কোম্পানি শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের তৈরি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করছে। সেসব তথ্য পেলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তাদের গাইডলাইন হালনাগাদ করবে।
অন্য দেশগুলো কী করছে?
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং কিছু ইউপোরীয় দেশ বড় পরিসরে শিশুদের টিকা দিতে শুরু করেছে। তবে যুক্তরাজ্য, নরওয়েসহ আরও কিছু দেশ শিশুদের প্রথম ডোজ দেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ স্থগিত রেখেছে আরও তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার জন্য।
এর একটি বড় কারণ বিরল কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যা কখনও কখনও শিশুদের মধ্যে দেখা গেছে।
নরওয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ফাইজারের টিকার এক ডোজ মোটামুটি ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দেয় এবং তা ১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত কার্যকর থাকার তথ্য এসেছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে।
তাছাড়া কোভিডে আক্রান্ত শিশুদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সুতরাং শিশুদের সবাইকে দ্রুত টিকার আওতায় আনার বিষয়টিতে তারা এই মুহূর্তে জরুরি মনে করছে না।
তাছাড়া কিশোর-তরুণদের ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের প্রদাহের সঙ্গে টিকার দ্বিতীয় ডোজের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এটাও বিবেচনায় রাখছে নরওয়ের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ।
ইংল্যান্ডের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা বলেছেন, তারা ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের ফাইজারের কোভিড টিকার একটি ডোজ দেওয়ার পরামর্শ দেবেন। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার আগে তারা আগামী বসন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান, কেননা তার মধ্যেই আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলো থেকে এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা মিলবে বলে তারা আশা করছেন।
বাংলাদেশের গবেষকরা কী বলছেন?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু বলছেন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনায় নিয়ে শিশুদের আপাতত এক ডোজ টিকাই দেওয়া উচিত। যুক্তরাজ্যে যেসব শিশুর কোমর্বিডিটি আছে তাদেরই কেবল দুই ডোজ দেওয়া হচ্ছে।
“এর বাইরে অন্যদের এক ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। আর আমাদের দেশে শিশুদের দেওয়া হবে অ্যাডাল্ট ডোজ। এ বিষয়টি নিয়েও পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক আছে।”
“তাদের একটি অল্প অংশকে টিকা দেওয়া অবস্থায় শিশুদের টিকা দেওয়া হচ্ছে, যারা সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমি শিশুদের টিকা দেওয়ার পক্ষে, কিন্তু সেটা কোন সময়? যখন আমরা সত্যিকারের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা, মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে তাদের সংখ্যা কমাতে পারব।”
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন অবশ্য মনে করেন, শিশুদের ফাইজারের টিকার পূর্ণ ডোজই দেওয়া উচিত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শিশুদের দুই ডোজ টিকার পাশাপাশি পরিবারের বাকিদেরও টিকা দিতে হবে। ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা অনুযায়ী, শিশুদের ফাইজারের টিকা দিলে দুই ডোজই দেওয়া উচিত।
“বাচ্চাকে টিকা দেওয়ার পাশাপাশি ওই বাচ্চার ফ্যামিলির সবাই যেন টিকা নেয়। কারণ সবাই টিকা না নিলে এক পর্যায়ে সেও সুরক্ষিত থাকছে না।”
তিনি জানান, বাংলাদেশ নিজ উদ্যোগেই শিশুদের টিকা দিচ্ছে। শিশুদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনও কোনো সুপারিশ করেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী বলছে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ন্যাশনাল ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা অবশ্য বলেছেন, সরকার শিশুদের ফাইজারের টিকার দুটি ডোজ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনেই।
“এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দুই ডোজেরই সুপারিশ করেছে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের জন্য। আমরা ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা যেভাবে আছে সেভাবেই টিকা দিচ্ছি। এ বিষয়ে আলাদা করে কিছু এখনও বলেনি।
“বিভিন্ন দেশ পরীক্ষামূলকভাবে সিঙ্গেল ডোজ দিচ্ছে। কিন্তু ডব্লিউএইচও সবকিছু কম্পাইল করেই একটা নির্দেশনা পাঠায়। এ কারণে আমরা প্রথম থেকেই ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা ফলো করছি।”
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন, টিকা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপের (নাইট্যাগ) সদস্য ডা. বে-নজীর আহমেদ।
এর মধ্যে রয়েছে- ডব্লিওএইচও, যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ), ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ), যুক্তরাজ্যের মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার রেগুলেটরি এজেন্সি (এমএইচআরএ)।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক বলেন, নাইট্যাগ মনে করে, ১৮ বছরের ওপরের নাগরিকদের আগে শিশুদের টিকাদান শেষ করা উচিত।
“অনেক দেশ অনেক কিছু করছে। কিন্তু আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো কি পরামর্শ দিচ্ছে সেটা মেনে চলছি। সে হিসাবে দুই ডোজ টিকাই দেওয়া উচিত।”
[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে।]
আরও পড়ুন: