ক্লাসের জন্য কতটা প্রস্তুত স্কুল?

করোনাভাইরাস মহামারীর দেড় বছর পর ক্লাস শুরুর অপেক্ষায় থাকা রাজধানীর কিছু স্কুলে খোলার প্রস্তুতি চললেও বেশিরভাগেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2021, 06:12 AM
Updated : 8 Sept 2021, 08:19 AM

গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজ স্বভাবতই অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে গজিয়েছে ঘাস। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে ক্লাস শুরু হচ্ছে রোববার।

তাই শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় হাত ধোয়া ও তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনাও রয়েছে সরকারের।

সরাসরি ক্লাসে যাওয়ার আগে বিভিন্ন স্কুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ এসব বিষয়ে সার্বিক তোড়জোড় শুরুর পাশাপাশি নতুন রুটিন তৈরির কাজ চলছে। অনলাইন ক্লাস চালু রাখার পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো স্কুলে।

তবে খোলার আর চারদিন বাকি থাকতে পল্লবীর শহীদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। ফটকের দুপাশেই অটোরিকশা, প্রাইভেট কার আর রিকশার গ্যারেজ করা হয়েছে।

স্কুলের ভেতরটা ধুলাবালিতে ভরা; লাইব্রেরির সামনেই ভাঙা ইঁট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে; উল্টে পড়ে আছে টেবিল। স্কুলের মাঠে বৃষ্টির পানি, ময়লা জমে আছে।

এক দল যুবককে দেখা গেল মাঠে আড্ডা দিতে। এরা নিয়মিতই স্কুলে ‘নেশা করতে আসে’ বলে জানায় এই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানাল।

তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী মনি জানায়, তারা পরীক্ষার খাতা জমা দিতে প্রায়ই স্কুলে আসে। কিন্তু স্কুলের ক্লাসরুম, টয়লেট পরিষ্কার করা হয় না।

“অনেক নোংরা.. মাঠে এর আগেও ময়লা জমছিল। আমরা পরিষ্কার করছিলাম। পানি জমলে তো ডেঙ্গু হবে। কিন্তু আমরা বললেও পরিষ্কার করে না স্যাররা।

“মাঠের ভিতরে এসে ছেলেরা গাঁজা খায়। ময়লা ফেলে দিয়ে যায়। স্কুল তো শুরু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এমন অপরিষ্কার পরিবেশে ক্লাস করব কেমনে?”

মিরপুর ১০ নম্বরের মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট এবং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রাঙ্গণে ময়লা ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

স্কুলের প্রভাতি শাখার ইনচার্জ আমিনা রশীদ বলেন, “ক্লাসরুম পরিষ্কার করা হচ্ছে। আবারও করা হবে। মাত্র তো ঘোষণা এলো।”

তাপমাত্রা মাপা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।

এই শিক্ষিকা বলেন, “সিটপ্ল্যান করব। কোন ক্লাস কবে, কখন আসবে- এগুলো আমরা করে ফেলব। টিচারদের সাথে মিটিং করে এগুলো চূড়ান্ত করব। বাচ্চারা যেন খাবার নিয়ে আসে, বাইরের খাবার না খায়; অভিভাবকদের সে নির্দেশনা দিয়ে দেব। তাদের হ্যান্ডওয়াশ, হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে দিতে বলব।”

মিরপুরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়েও নতুন করে কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি। একটি শ্রেণিকক্ষে দেখা যায় বেঞ্চ উল্টো করে রাখা। হাত ধোয়ার আলাদা কোনো ব্যবস্থাও করা হয়নি।

এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নূরে আলম বলেন, “অনলাইন কার্যক্রমের পাশাপাশি আমরা প্রতি সপ্তাহেই স্কুল পরিষ্কার করতাম। এ কারণেই আমাদের প্রস্তুতি মোটামুটি হয়ে গেছে। আমরা আজকে মিটিং করেছি। জীবানুনাশক ছিটিয়ে আবারও স্কুল পরিষ্কার করা হবে।

“খসড়া রুটিন করে ফেলেছি। অনলাইনেও ক্লাস চলবে। অনেকের একদিন করে ক্লাস, তারা বাকি দিন কী করবে? আবার অনেক অভিভাবক এতো সহজে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাইবে না। তাদের জন্য অনলাইনে ক্লাস চলবে।”

তিনি জানান, বিদ্যালয়ে তাপমাত্রা মাপার দুটি যন্ত্র আছে, আরও কেনা হবে।

গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া জানান, শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুটিন তৈরির কাজ করছেন তারা। সরাসরি ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগও রাখা হচ্ছে।

মহামারী পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলকে তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, “ক্লাসরুম আগে থেকেই পরিষ্কার আছে। ক্যাম্পাসও প্রতি সপ্তাহে আমরা পরিষ্কার করি। কারণ ডেঙ্গুর কারণে আমরা রেগুলার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখছি।

“বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে আমরা স্কুলে ঢোকার গেইটে বেসিন, সাবান রাখা ও পানির ব্যবস্থা করছি হাত ধোয়ার জন্য।”

মিরপুর ১২ নম্বরের এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের তিনটি গেইটের পাশে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছে। মাঠের ঘাস মেশিনে কেটে দেওয়া হচ্ছে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসাইন বলেন, “ক্লাসরুমগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে, জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। ল্যাবগুলোর প্রস্তুতিও চলছে।

“তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র অলরেডি কিনে ফেলেছি। তাপমাত্রা মাপার পরেই তারা হাত ধুতে যাবে। স্যানিটাইজারের ব্যবস্থাও থাকবে। কেউ ভুলে মাস্ক পরে না আসলে তাদের জন্য মাস্ক রাখা হবে গেইটে।”

শ্রেণি বণ্টনের কাজ হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিদিনই পঞ্চম, দশম ও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস থাকলেও ভিড় এড়াতে আধা ঘণ্টা পর পর একটি ক্লাস ঢুকবে। এক সাথে সবাই ঢুকলে হাত ধোয়ার সুযোগও পাবে না।”

বড় ক্যাম্পাস, যথেষ্ট ক্লাসরুম থাকা ও ধাপে ধাপে শিক্ষার্থী আনায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে সমস্যা হবে না বলে মনে করেন এই শিক্ষক।

শিক্ষক-কর্মচারীরা টিকা নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “২৫ থেকে ৩০ বয়সী ৪/৫ জন শিক্ষক বাকি আছেন, তারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এসএমএস আসলেই টিকা নিয়ে নেবেন।”

সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হামিদা আলী বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের প্রবেশফটকে হাত ধোয়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজ করার জন্য প্রস্তুতি চলছে।

“আগে বাচ্চাদের ভালো রাখতে হবে। তারপর পড়াশুনা। ক্লাসেও আমরা এ বিষয়ে নির্দেশনা দিব শিক্ষার্থীদের। আমাদের যতটুকু সম্ভব আমরা করব। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। তাদের সবাইকে আমরা বলব- বাচ্চাদের যেন ছোট একটা স্যানিটাইজার দিয়ে দেয়।”

স্কুল খোলায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা উৎসাহী হয়ে উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রথমে বড় ক্লাসগুলো এনে পরে আস্তে আস্তে ছোট ছোট ক্লাসগুলো নিয়ে আসব।”

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর গত বছর ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিস্থিতি ‘অনুকূলে’ না আসায় দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়েছে।

তবে সম্প্রতি সংক্রমণের মাত্রা কিছুটা কমে আসায় সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আগামী ১২ সেপ্টম্বর থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন। 

এরপর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানান, প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে একদিন করে ক্লাসের চিন্তা করা হচ্ছে।