স্কুলে ফিরবে বাচ্চারা, চলছে খুশির প্রস্তুতি, সঙ্গে আছে উদ্বেগও

স্কুল বন্ধ দেড় বছর ধরে, কিন্তু মিরপুরের লিটল ফ্লাওয়ার্স প্রিপারেটরি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির আরিয়ানের বয়স তো আর থেমে নেই; এই সময়ে তার স্কুল ড্রেস ছোট হয়ে গেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2021, 06:11 PM
Updated : 6 Sept 2021, 06:11 PM

অবশেষে স্কুল খোলার ঘোষণা আসায় তার মনে এখন নতুন উত্তেজনা; সেজন্য এরই মধ্যে মনে মনে তৈরি হতে শুরু করেছে আরয়িান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে বললো, “স্কুল খুললে তো আগে স্কুল ড্রেস লাগবে। সেটা বানাব। সব সাবজেক্টের বই-খাতা সবকিছু রেডি করছি। অনেকদিন পর স্কুলে যাব, খুব ভালো লাগছে।”

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণায় এমন আনন্দের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে।

দীর্ঘ ছুটির পর শ্রেণিকক্ষে ফেরা নিয়ে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ যে কিছুটা মানসিক চাপে রয়েছে, সে কথাও বললেন অভিভাবকরা।

বহু দিন পর সহপাঠীদের সাথে মেলার অপেক্ষায় রয়েছে শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি এতদিন পর শ্রেণিকক্ষের বাঁধা রুটিনে কেমন লাগবে, সে ভাবনাও আসছে তাদের মনে।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১২ সেপ্টেম্বর খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার।

পার হয়ে গেছে দেড় বছর, ছোট হয়ে গেছে অনেকের স্কুল ড্রেস

স্কুল বন্ধ থাকলেও এতদিন অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে এসেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে অনেক শিক্ষার্থীই এর বাইরে থাকায় সরাসরি ক্লাস নেওয়ার দাবি আসছিল নানা মহলে।

রোববার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে পঞ্চম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস প্রতিদিন হবে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস হবে।

মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী রিফাত আমিন জানালো, এই ঘোষণার জন্য সে অপেক্ষায় ছিল বহু দিন ধরে।

“এতোদিন ধরে স্কুল বন্ধ! বারবারই তো ছুটি বেড়েছে। কিন্তু স্কুল যে এভাবে খুলে যাবে- চিন্তাই করিনি। খু্ব ভালো লাগছে। তবে আমাদের জন্য আরও আগে খুললে ভালো হত।

“যারা পরীক্ষার্থী, শুধু তাদের জন্য আগেই খুলে দেওয়া উচিত ছিল। সরাসরি ক্লাস করলে হয়ত প্রিপারেশনটা আরও ভালো হত। তবুও যে খুলছে- এতেই অনেক খুশি।”

একটি বেসরকারি কোম্পানির চাকুরে ফরিদুল ইসলামের ছোট ছেলে সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আরেক ছেলে গুলশান কমার্স কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ায় ‘খুব ভালো হয়েছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাসায় থাকতে থাকতে বাচ্চারা বিরক্ত হয়ে গেছে। একঘেয়েমি এসে গেছে। পড়াশোনাটা এখন সিরিয়াসলি করতে চায় না। অনলাইনে সেভাবে পড়াশোনা হয়ও না। এখন কিছুটা হলেও শিখবে।”

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি স্কুলের খেলার মাঠে শিক্ষার্থীদের পদচারণা না থাকায় বড় হয়েছে ঘাস। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

একই কারণে স্কুল খোলায় খুশি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাগিব নেহাল। ক্লাস কবে শুরু হবে, কীভাবে হবে তা জানতে ইতোমধ্যে স্কুলে যোগাযোগও করেছে সে।

সে বললো, "বন্ধুদের সাথে দেখা হবে ভেবে ভালো লাগছে। তাছাড়া অনলাইনে ক্লাসের চেয়ে ফিজিক্যালি ক্লাসে বুঝতে সুবিধা হয়। অনলাইনে নেটের গতি কম থাকে, সেজন্য ক্লাস করতে বিরক্তি লাগে।"

শহীদ আনোয়ার লেফটেন্যান্ট গার্লস কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাইমিনা ইসলাম অবশ্য জানালো, স্কুল না যাওয়ার দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা নিয়ে চিন্তায় আছে সে।

“স্কুল শুরু হচ্ছে- ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা হবে। এত খুব ভালো লাগছে। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার চিন্তায় আছি। অনেকদিন তো সকালে উঠি না। আগের মত সবকিছুতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে।”

মোহাইমিনার বড় বোন হলিক্রস কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মুনতাহা চিন্তিত যানজট সমস্যা নিয়ে।

“এখন সবচেয়ে বড় টেনশন হচ্ছে যানজট। পরীক্ষার জন্য তো আমাদের হাতে সময় অনেক কম। মিরপুর থেকে ফার্মগেইটে যাওয়া-আসাতেই তিন-চার ঘণ্টা নষ্ট হয়ে যাবে।”

তাদের মা চিকিৎসক নাহিদ ফারহানা চৌধুরী বলেন, “স্কুল থেকে যেভাবে ডিরেকশন দেবে, সেভাবেই আমরা বাচ্চাদের পাঠাব।”

সন্তানের সুরক্ষার বিষয়ে চিন্তিত এই অভিভাবক বলেন, “আমরা তো মাস্ক পরিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাচ্চাদের স্কুল-কলেজে পাঠাব। কিন্তু স্কুলের ভেতরে গিয়ে ওরা কতটুকু মানবে- সেটাই বিষয়। স্কুলের ভেতরে হাত ধোয়া- স্যানিটাইজের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা জরুরি।”

স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মানার ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও যে পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “স্কুল-কলেজেও স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি মনিটরিং করতে হবে। আরেকটা বড় বিষয় হল, সব শিক্ষকদের টিকা নিশ্চিত হয়েছে কিনা।”

এই অভিভাবক মনে করেন, এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো নিয়ে আরও ভাবা উচিত।

শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, স্কুল-কলেজে কেউ মাস্ক ছাড়া ঢুকতে পারবে না। কেউ অসুস্থ থাকলে তাকে শ্রেণিকক্ষে না পাঠানোর পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

স্কুলব্যাগটা ব্যবহার করা হয়নি অনেক দিন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসায় সুরক্ষা নিয়ে ‘এখন ভয় অনেকটা কম’ থাকলেও সবার যে সতর্ক থাকা দরকার, সে কথাই বললেন মগবাজারের গৃহিনী সুফিয়া আক্তার।

"বাচ্চাদের মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে দিব। সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সচেতন হলে রিস্কটা কমে আসবে। স্কুলগুলো যেন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে, তাহলেই সমস্যা হবে না।"

তার মেয়ে পড়ছে মালিবাগের ফয়জুর রহমান আইডিয়াল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে। আর ছেলে ঢাকা ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। স্কুল-কলেজ খুলছে জেনে তারাও 'খুব খুশি।'

সুফিয়া বলেন, "বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হবে। এতদিন তাদের একদম পড়াশোনা হয়নি। বন্দি জীবন ছিল, এক ধরনের আতঙ্কে থাকত। এখন ক্লাসে গেলে স্বাভাবিক জীবনটা ফিরে পাবে তারা।"

তবে সংক্রমণ ‘সন্তোষজনক পর্যায়ে’ নেমে না আসায় সন্তানদের এখনই স্কুলে পাঠাতে চান না পল্লবীর আসমুনা মর্তুজা। তার দুই মেয়ে মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের প্রথম ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

তিনি বলেন, “স্কুল খুললেও এখন কোনভাবেই বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাব না। তাদের বেশ কয়েকজন ক্লাসমেট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, হাসপাতালেও ভর্তি আছে। জেনেশুনে তো তাদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না। সংক্রমণ কমলেই পাঠাব।”

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

আসমুনার মত অভিভাবকদের কেউ কেউ মনে করেন, সংক্রমণের হার ৫ শতাংশে নিচে নামলে তখন স্কুল খোলাই নিরাপদ হত।

স্কুলে বাচ্চাদের স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে উদ্বিগ্ন তেঁজগাওয়ের মনির হোসেন মনে করেন, আরও ২-৩ মাস অপেক্ষা করা উচিত ছিল।

"স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে। কিন্তু বাচ্চারা তো একসাথে হবেই, কীভাবে মানাবে? আর বাচ্চারাও তো আক্রান্ত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে একসাথে মিশলে ঝুঁকি তো থাকবে।

"এর আগে সংক্রমণ আরও কম ছিল। তখন স্কুল খোলেনি। এখন এত তাড়াহুড়া কেন করছে? যেহেতু সংক্রমণ কমছে, কিছুদিন অপেক্ষা করলেই তো ঝুঁকিটা আর থাকত না।”

তার মেয়ে তেজগাঁওয়ের হলি মডেল কিন্ডারগার্টেনের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস স্মিতাও কিছুটা ‘মানসিক চাপে’ রয়েছে বলে জানালেন মনির হোসেন।

তিনি বলেন, “বাচ্চাকে স্কুলে যাবার কথা বলার পর শুরুতে বললো- যাবে না। পরে অন্যরাও যাবে শুনে বলছে সে যাবে। অনেকদিন বন্ধ থাকার কারণে একটু দোটানায় আছে।”