অ্যাডভোকেট যুথি ও তার মেয়ে ইতিহাদের ক্ষতিপূরণ পাবেন ২০ মাসে

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথি ও তার মেয়ে তানজিন বৃষ্টিকে ২০টি মাসিক কিস্তিতে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে ইতিহাদ এয়ারওয়েজকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2021, 01:43 PM
Updated : 16 June 2021, 01:43 PM

দশ বছর আগে টরন্টো যেতে না দিয়ে আবুধাবি বিমানবন্দরে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনায় তাদের ওই ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে।

আদালত বলেছে, বাংলাদেশের ওই দুই যাত্রীকে মাঝপথে নামিয়ে দিয়ে ‘স্বেচ্ছাচারী, অযৌক্তিক ও অসদাচরণ’ করেছে ইতিহাদ এয়ারওয়েজ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথি যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী। ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট মামলাটি করেছিলেন যুথির মেয়ে বৃষ্টি।

সেই রিটে ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ গত বছর ৮ অক্টোবর রায় দেয়।

বুধবার প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সমান ২০টি মাসিক কিস্তিতে মা ও মেয়েকে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইতিহাদ এয়ারওয়েজকে।

আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী রিপন বাড়ৈ ও সঞ্জয় মণ্ডল।

ইতিহাদ এয়ারওয়েজের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হেসেন কিউসি। তার সঙ্গে ছিলেন মো. আজিজ উল্লাহ ইমন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনি।

২০১১ সালে ২৮ জুন কানাডা যাওয়ার জন্য ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের ইতিহাদ এয়ারলাইনসের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নেন তানজিন বৃষ্টি ও তার মা নাহিদ সুলতানা যুথি। তার মধ্যে একটি ঢাকা-আবুধাবী EY 253 ফ্লাইটের জন্য, অন্যটি আবুধাবী-টরন্টো EY 141 ফ্লাইটের জন্য।

পরদিন সকাল ৮টায় তারা আবুধাবি বিমানবন্দরে পৌঁছান। তাদের পরবর্তী ফ্লাইটটি (আবুধাবি-টরন্টো) আবুধাবীর স্থানীয় সময় রাত ১০টায় নির্ধারিত ছিল। যথাসময়ে তারা EY 141 ফ্লাইটের জন্য লাইনে দাঁড়ান।

চেক-ইন শেষে তানজিন বৃষ্টিকে ওয়েটিং রুমে ঢুকতে দিলেও বোর্ডিং পাসে সিল না থাকায় তার মা নাহিদ সুলতানা যুথিকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে ইতিহাদের কর্মীরা মা ও মেয়েকে জোর করে দেশে ফিরতে বাধ্য করেন।

ঢাকায় ফিরে তানজিন বৃষ্টি ২০১১ সালের ৩০ জুন বিমানবন্দর থানায় জিডি করেন। পরে ই-মেইলে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (আইসিএও) কাছেও অভিযোগ করেন।

এরপর ওই বছরের ৪ জুলাই ঢাকায় ইতিহাদের কান্ট্রি ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ জমা দিয়ে ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন বৃষ্টি। তাতে সাড়া না পেয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন তিনি।  

রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত ওই বছরের ১৪ জুলাই রুলসহ আদেশ দেয়। আদালত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলে। সেই সাথে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কান্ট্রি ম্যানেজারকে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।

আটক, হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগ বিচারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করার জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং এ দুই যাত্রীকে ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে সে সময় রুলও জারি করে হাই কোর্ট।

ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কান্ট্রি ম্যানেজার হাজির হয়ে ব্যাখ্য দেওয়ার পর মামলার রুল শুনানির শুরু হলে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের আদালত মামলাটি শুনানিতে অপারগতা প্রকাশ করে।

পরে প্রধান বিচারপতি রুল শুনানির জন্য মামলাটি বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চে পাঠান। শুনানি শেষে গত বছর ৮ অক্টোবর ওই বেঞ্চ রায় দেয়।

২০১৮ সালে ১৪ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, “এটি কাচের মত স্পষ্ট যে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কর্মকর্তারা রিট আবেদনকারী এবং তার মায়ের সাথে অন্যায়, রুঢ়, অপেশাদার,অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিল এবং আবেদনকারীর মায়ের বোর্ডিং পাসে সিল না থাকার বিষয়টি সমাধান না করে অন্যায়ভাবে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

“সার্বিক পর্যালোচনায় এবং আলোচনায় আমাদের দ্বিধাহীন মতামত হল, ইতিহাদ এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষের অবহেলা, হয়রানিমূলক আচরণ, জোর করে তাদের মালামাল বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়া এবং দেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য করা সম্পূর্ণ বেআইনি ও এখতিয়ারবহির্ভূত।”

এ কারণে দ্য ক্যারেজ বাই এয়ার (ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন) অ্যাক্ট, ১৯৬৬ এর প্রথম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত ১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিট আবেদনকারী ও তার মায়ের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ইতহাদ এয়ারওয়েজ দায়ী বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে হাই কোর্ট।

রায়ে বলা হয়েছে, ওই আইনের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যাত্রী প্রতি সর্বোচ্চ দুই লাখ ৫০ হাজার ফ্রাঙ্ক দিতে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বাধ্য।

এসব আইনি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রিট আবেদনকারীর ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে জারি করা রুলটি যথাযথ ঘোষণা করা হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে মহামারীর কারণে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে রিট আবেদনকারী তানজিন বৃষ্টি ও তার মাকে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।

সেই সঙ্গে এ রায়ে  ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছে হাই কোর্ট। এর একটিতে ইতিহাদ এয়ারওয়েজকে নারী যাত্রীদের সঙ্গে অধিকতর সতর্কতার সাথে সম্মানজনক আচরণ করতে বলা হয়েছে।

আরেক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আকাশ পথে যাত্রী এবং যাত্রীর মালপত্র, পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে (আইসিএও) আরও বেশি তৎপর হতে হবে।

যাত্রী সেবায় আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির সমালোচনায় আদালত বলেছে, আইসিএও-এর কার্যক্রম যতটা যাত্রীবান্ধব, তার চেয়ে বেশি পরিবহনসংস্থা বান্ধব। যেহেতু বর্তমান বিশ্বে যাত্রী এবং পণ্য দ্রুত পরিবহনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম আকাশ পথ, সেহেতু আকাশ পরিবহন সংস্থা এবং যাত্রী সাধারণের মধ্যে দায়-দায়িত্ব আরও বেশি সহজ-সরল, সুনির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট হওয়া উচিত।

“বিশেষ করে সাধারণ যাত্রী এবং পণ্যের মালিককে সুরক্ষা দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশাল বিমান সংস্থার সামনে সাধারণ যাত্রী নিতান্তই অসহায়। তাই আইসিএও এর প্রধান উদ্দেশ্য এবং কাজ হবে সাধারণ যাত্রীরা যেন অধিকার আদায়ে কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোনো বাধা বিপত্তির মুখে না পড়েন সেটি দেখা।”