আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনানের খোঁজে সরকারি দপ্তরে ঘুরছেন তার স্ত্রী

ঠিকানা ধরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পল্লবীর লালমাটিয়া এলাকায় গিয়ে জানা গেল, ওই বাসায় সাবিকুন্নাহার নেই; স্বামী আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনানের খোঁজে সরকারি দপ্তরে ঘুরছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2021, 04:08 AM
Updated : 19 June 2021, 01:09 PM

ওই বাসাটির নীচতলার দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একটি বালিকা মাদ্রাসার কার্যক্রম চলছে। এর মূল উদ্যোক্তা ইসলামী বক্তা হিসেবে পরিচিত আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনান, যিনি প্রায় আটদিন ধরে তিন সঙ্গীসহ নিখোঁজ রয়েছেন।

স্বামীর খোঁজে স্থানীয় থানা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পুলিশ সদর দপ্তর, র‌্যাব সদর দপ্তর সব জায়গাতেই ঘুরেছেন বলে জানালেন আদনানের দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার। কোথাও আশা পেয়েছেন; কোথাও কোনো পাত্তাই পাননি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাবিকুন্নাহার যে চিঠিটি জমা দিয়েছেন, তাতে তিনি লিখেছেন, গত ৮ জুন রংপুর থেকে একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো গ ৩৩-৪৩৪২) ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন আদনান। তার সঙ্গে ছিলেন আব্দুল মুহিত, মোহাম্মদ ফিরোজ ও গাড়িচালক আমির উদ্দীন ফয়েজ। গাড়িটিসহ এদের চারজনেরই কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অনলাইনে আদনানকে নিয়ে ভাসছে নানা কথা-বার্তা।

সাবিকুন্নাহার বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ বলছে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কেউ বলছেন তাকে পাওয়া গেছে। এসব নানা গুজবের মধ্যে তিনি স্বামীকে ফিরে পেতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আদনানের পারিবারিক বাড়ি রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোডের আহলে হাদিস মসজিদ এলাকায়। তবে তিনি প্রথম স্ত্রী হাবিবা নূর, দেড় বছরের ছেলে ও তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে শালবন মিস্ত্রীপাড়া চেয়ারম্যান গলিতে ভাড়া বাসায় থাকেন।

আদনানের মা আজেদা বেগম শুক্রবার (১১ জুন) বিকালে ছেলের সন্ধান চেয়ে রংপুর কোতোয়ালি থানায় জিডি করেছেন।

খেলোয়াড় থেকে ইসলামী বক্তা

রংপুরের এক সময়কার ক্রিকেট খেলোয়াড় আফসানুল আদনান ত্ব-হা পড়াশোনা করেছেন কারমাইকেল কলেজে।

আজেদা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দর্শনে স্নাতকোত্তর করে বাড়ির পাশে আল জামেয়া আসসালাফিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছেন আদনান।

আদনান অনলাইনে আরবি পড়ানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে জুমার খুতবা দেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানান। তিনি ধর্মীয় বক্তা হিসেবেও পরিচিত; তার ফেইসবুকে পেইজের অনুসারীর সংখ্যা ৫২ হাজার।

সাবিকুন্নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন বলেন, “ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে আলেমদের একটি পক্ষের সঙ্গে তার মতবিরোধ তৈরি হয়। এসব কারণে তিনি পরিচিত আলেমদের কাছে সাহায্য চেয়েও কোনো সাড়া পাননি। বরং সাধারণ মানুষ ও অনুসারীরা আদনানকে ফিরে পেতে অনলাইনে অনেক বেশি সোচ্চার।”

যেভাবে নিখোঁজ

সাবিকুন্নাহার জানান, রংপুরের বাড়ি থেকে ওইদিন বগুড়ায় একটি ধর্মীয় সভায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল আদনানের। এরপর ঢাকায় আসার কথা। বিকেল ৪টার দিকে রংপুর থেকে একটা কারে করে বগুড়ার উদ্দেশ্যে বের হন তিনি। ওই গাড়িটির মালিক রংপুরের আমির উদ্দীন, তিনিই চালান। সাধারণত রংপুর থেকে ঢাকা যাতায়াতের ক্ষেত্রে আমির উদ্দীনের গাড়িটি ব্যবহার করতেন আদনান।

রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফোনে আদনান জানান, দুটি মোটরসাইকেলে চারজন তার গাড়িটিকে অনুসরণ করছে। পরে ‘হয়তো ভয়ে বা উদ্বিগ্ন হয়ে’ তিনি বগুড়ার সভায় যোগ না দিয়ে ঢাকার পথ ধরেন। তার সঙ্গে আব্দুল মুহিত ও মোহাম্মদ ফিরোজ নামে যে দুজন ছিলেন তারা মূলত আদনানকে বগুড়ার সভায় নিতে এসেছিলেন।

পরে পরিস্থিতি বুঝে তারা আদনানকে ঢাকা পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাত আড়াইটার দিকে তার গাড়ি গাবতলী পৌঁছেছে বলে স্ত্রীকে জানান আদনান। এরপর থেকেই আর কোন যোগাযোগ নেই।

আদনানের প্রথম স্ত্রী হাবিবা নূরও বলেছেন, বৃহস্পতিবার রাত ৩টা থেকে তার ফোন বন্ধ পান তিনি।

“রাত ২টা ৩৬ মিনিটে আদনানের সাথে আমার শেষ কথা হয়। তিনি তখন বলেছেন কাছাকাছি চলে আসছেন। উনি তখন গাবতলী ছিলেন।”

গাবতলীতে পৌঁছানোর বিষয়ে কীভাবে নিশ্চিত হলেন জানতে চাইলে দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার বলেন, সাধারণত আদনান বাড়ির বাইরে গেলে তিনি (স্ত্রী) ফোন করে অবস্থান জানতে চান। আদনান গুগল ম্যাপ থেকে নিজের অবস্থান (লোকেশন) বের করে তার একটা স্ক্রিনশট নিয়ে স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেন। সর্বশেষ তিনি গাবতলীর লোকেশন পাঠান।

কারা আদনানকে ধরে নিতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আদনান বক্তব্যে যেসব কথা বলতেন, তা অনেক সময়ই সরকারের বিপক্ষে যেত। এসব নিয়ে নিজের একাধিক বক্তব্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আদনান।”

রাতে ফেইসবুক লাইভে এসে সাবিকুন্নাহার বলেন, কোনো অপহরণকারী টাকার জন্য এটা করেছে এমনটা তিনি মনে করছেন না। ত্বহা আদনান যে খুব ধনী নন এটা সবাই জানেন।

সন্দেহজনক কল, হোয়াটসঅ্যাপ খোলা

লাইভে সাবিকুন্নাহার বলেন, আদনান নিখোঁজের পর তার কাছে দুটি সন্দেহজন কল এসেছিল। একটা অপরিচিত নম্বর থেকে বলা হয়েছিল, আদনানকে ছাড়াতে টাকা লাগেবে। এরপর আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। যে নম্বর থেকে ফোন করা হয়েছে সেই নম্বরে কল ঢুকছে না।

আর অনেকদিন ধরেই বন্ধ আবু ত্ব-হা আদনানের একটি পুরনো নম্বর থেকেও ফোন করে একজন পুরুষ কয়েকবার জানতে চান, ‘আপনি কী আদনানের স্ত্রী।’ তখন সাবিকুন্নাহার এপাশ থেকে কয়েকবার পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কে বলছেন, আপনি কে বলছেন’। এক পর্যায়ে ফোনটি কেটে দেওয়া হয়। এরপর আর কোনো কল আসেনি।

তবে আদনানের হোয়াটসঅ্যাপ মাঝে মাঝে খোলা হচ্ছে, অর্থাৎ কিছুক্ষণের জন্য অনলাইন থেকে আবারও অফলাইন হয়ে যাচ্ছে।

মঙ্গলবার রংপুরের পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়ে একজন সাবিকুন্নাহারকে দুবার ফোন করে আবু ত্বহার কোনো খবর পাওয়া গেছে কিনা তা জানতে চান। খবর পেলে যেন পুলিশকে জানান।

স্বামীর পাঠানো গাবতলীর লোকেশন ম্যাপ হাতে সাবিকুন্নাহার গিয়েছিলেন রাজধানীর দারুস সালাম থানায়। তবে পুলিশ তার মামলা বা জিডি নেয়নি।

এ বিষেয়ে জানতে চাইলে দারুস সালাম থানার ওসি তোফায়েল আহাম্মেদ সাংবাদিকদের বলেন, আবু ত্ব-হা আদনানের স্ত্রী সাবিকুন্নাহার থানায় এসেছিলেন। আদনান কোথা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন সে বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় তার অভিযোগ গ্রহণ করা যায়নি।

নিখোঁজ বাকি তিনজনের পরিবারের সঙ্গেও সাবিকুন্নাহার যোগাযোগ রাখছেন। ওই তিনজনের পরিবার রংপুরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

অ্যামনেস্টির উদ্বেগ

আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনানসহ চারজন নিখোঁজের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আদনানকে খুঁজে পেতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার হয়েছেন অনেক মানুষ।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সাউথ এশিয়ার ফেসবুক পেইজে গত সোমবার বলা হয়, ওই চারজনের অবস্থান অবস্থান জানতে কর্তৃপক্ষের উচিত তাৎক্ষণিক সুষ্ঠু তদন্ত পরিচালনা করা। আর তারা যদি রাষ্ট্রের হেফাজতে থেকে থাকে তবে এখনই তাদের মুক্তি দিতে হবে।

গত বছরের ২৮ আগস্ট ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব দ্যা ভিকটিমস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স’ উপলক্ষে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ১২টি সংগঠনের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের ৫৭২ জনকে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ।

এদের কয়েকজনকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, কারও লাশ পাওয়া গেছে, কেউ কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন আবার কারও খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।