স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার, পরীক্ষা চলবে সাত কলেজে

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2021, 10:11 AM
Updated : 24 Feb 2021, 02:34 PM

বুধবার বিকালে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয় বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের জানান।

সাত সরকারি কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো অব্যাহত থাকবে। গতকাল এবং আজকের পরীক্ষাগুলোর তারিখ ওয়েবসাইটে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

তবে শর্ত দেওয়া হয়েছে, পরীক্ষা চলাকালে কলেজগুলোর হোস্টেল খোলা যাবে না এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাত কলেজের অধিভুক্ত অধ্যক্ষ মহোদয়গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যসহ আমাদের একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, এই সাত কলেজের চলমান এবং ঘোষিত পরীক্ষাগুলো পরীক্ষার্থীরা হোস্টেলে না ওঠার শর্তে চলমান থাকবে।

“আমি আশা করি, এই সাত কলেজের কোনো পরীক্ষা নিয়ে কোনো সংশয় থাকবে না, পরীক্ষাগুলো চলবে। কিন্তু আমাদের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ মে খুলবে আর হলগুলো খুলবে ১৭ মে। তার আগে সকল প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয় করবে। সেক্ষেত্রে যেখানে যে সহযোগিতা লাগবে, সে সহযোগিতা আমরা দেব।”

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও অধ্যক্ষদের এক সভায় সাত কলেজের সব পরীক্ষা ২৪ মে পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিল।

ওই সিদ্ধান্তের পর তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং হল-ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার দাবিতে নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।

পরীক্ষার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং হল-ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা বুধবার দুপুরে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

রাতে তারা ফিরে গেলেও বুধবার বেলা ১১টার দিকে আবার তারা নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করলে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

দুপুরে শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করলে শাহবাগ পর্যন্ত সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নগরীর বড় অংশজুড়ে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।

এদিকে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দুপুরে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য এবং সাত কলেজের অধ্যক্ষরা ওই ভার্চুয়াল সভায় অংশ নেন।

বিকাল পৌনে ৪টার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এলে সড়কে অবস্থান নিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন।

আনন্দ প্রকাশ করে স্লোগান দিতে দিতে তারা ফিরে গেলে বিকাল ৪টার পর থেকে সড়ক আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। 

পরীক্ষার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং হল-ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা বুধবার দুপুরে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কেন এই আন্দোলন?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমিয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়।

এরপর থেকে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজের ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হচ্ছে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সাত কলেজের তিনটি পরীক্ষা মাঝপথে আটকে যায়।

এর মধ্যে রয়েছে- মাস্টার্স শেষ পর্ব (২০১৬-১৭), মাস্টার্স প্রিলি (২০১৭-১৮), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ডিগ্রি স্পেশাল পরীক্ষা।

এ সময় অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হলেও পরীক্ষাগুলো শেষ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ বাড়তে থাকে। সংক্রমণের হার কিছুটা কমে আসার পর সরকার আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো নেওয়ার অনুমতি দিলে মধ্য জানুয়ারি থেকে তিন ভাগে অসম্পূর্ণ পরীক্ষাগুলো নেওয়ার রুটিন দেওয়া হয়।

সে অনুযায়ী পরীক্ষা নেওয়া শুরু হলেও তখন কলেজের হোস্টেল খোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

এদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সঙ্কটে থাকা শিক্ষার্থীরা হল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। গত রোববার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলের তালা ভেঙে ভেতরে অবস্থান নিলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তার আঁচ লাগে।

এরপর সোমবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, ঈদুল ফিতরের পর ২৪ মে থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু হবে। এর আগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনা হবে। ২৪ মে পর্যন্ত কোন বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ধরনের পরীক্ষা নিতে পারবে না। ২৪ মের পরে পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে। আর অনলাইনে যেভাবে ক্লাস চলছে, ওই সময় পর্যন্ত সেভাবেই চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো আগামী ১৭ মে থেকে খুলে দেওয়া হবে।

তার এই ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্বের পরীক্ষার্থীদের জন্য ১৩ মার্চ থেকে আবাসিক হল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। একইসঙ্গে পরীক্ষার রুটিনও বাতিল করা হয়। একই সিদ্ধান্ত জানায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও।

মঙ্গলবার বিকালে সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের  সভায় সব পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়।

সভা শেষে মাকসুদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অধিভুক্ত সাত কলেজের সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আগামী ২৪ মে থেকে ক্রম অনুযায়ী পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। এর আগে যেসব পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, সেসব পরীক্ষাও ২৪ মে পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।”

ওই ঘোষণার পর মঙ্গলবার রাতে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভের পর বুধবার সকালে বড় আকারে শিক্ষার্থী জমায়েত হয় নীলক্ষেত মোড়ে।

‘পরীক্ষা নিয়ে টালবাহানা, চলবে না, চলবে না’,‘চলমান পরীক্ষা নিতে হবে নিতে হবে,‘সাত কলেজের পরীক্ষা নিতে হবে নিয়ে নাও,’ ‘ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা নিতে হবে নিতে,’ ‘দাবি মোদের একটাই-মার্চে হল-ক্যাম্পাস খোলা চাই,’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন তারা।

ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহমুদা আক্তার বলেন,"আমাদের ফোর্থ ইয়ারের পরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই পর্যায়ে এসে পরীক্ষা স্থগিত করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ২০১৯ সালে যে পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা এখনও আটকে আছে। আমরা আর কত সেশনজটে পড়ে থাকব? আমরা আমাদের ক্যারিয়ার নিয়ে চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তায় আছি।"

একই কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্রী হাসিনা জান্নাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমাদের ফাইনাল ইয়ারের আর মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি। আজকে সেটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে পরীক্ষা স্থগিত করে দেওয়া হল। এটা আমাদের সাথে প্রহসন। একটা পরীক্ষার জন্য কি আরও এক বছর নষ্ট করতে হবে? এমনিতেই ২০১৯ সালের পরীক্ষা ২০২১ সালে নেওয়া হচ্ছে।"

তিতুমীর কলেজের তৃতীয় বর্ষের ওমর ফারুক বলেন, তাদের কয়েকটি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আরও চারটা বাকি আছে।

“পরীক্ষার জন্য আমরা অনেকে এই মহামারীর মধ্যে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ঢাকায় এসে মেসে উঠেছি। অনেকেই আর্থিক সঙ্কটে আছে। এর মধ্যে এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত, আমাদের হতাশ করেছে, দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।"

বেলা ২টার দিকে স্লোগান দিতে দিতে শাহীন আলম নামে সরকারি বাঙলা কলেজের গণিত বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়।

পরে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে দাবি পূরণের খবর এলে শিক্ষার্থীরা উল্লাস করতে করতে রাজপথ ত্যাগ করেন।