কিন্তু চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস হানা দিলে সরকারকে পিছপা হতে হয়। বাহ্যিক সামাজিক সব আয়োজন প্রায় চূড়ান্ত হলেও জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থগিত করা হয়।
মহামারীর বাধায় উদযাপন বাধাগ্রস্ত হলেও আশা ছাড়েনি বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে মুজিববর্ষের সময়কাল ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
মহামারী পরিস্থিতির উন্নতি হলে মুজিববর্ষের স্থগিত থাকা অনুষ্ঠানগুলো কখন কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা চলছে বলে জানিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে সরকার জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে ২০২০-২০২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে।
এজন্য ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ এবং ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’ নামে দুটি কমিটি গঠন করা হয়।
গত ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি থেকে ক্ষণগণনার মাধ্যমে মুজিববর্ষের আয়োজন শুরু হয়। সারা দেশে সরকারি, বেসরকারি দপ্তর, প্রতিষ্ঠানে ক্ষণগণনা যন্ত্র স্থাপন করা হয়; শুরু হয় মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চের।
সেই আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আবহও ‘প্রতীকীভাবে’ ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যে বিমানে করে দেশে ফিরেছিলেন, সেই আদলের একটি বিমানও হাজির করা হয় ক্ষণগণনা অনুষ্ঠানে।
এরপর সব পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকে। ১৭ মার্চ বর্ণাঢ্য আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ঘটা করে উদযাপন করবে- এমনই ছিল পরিকল্পনা। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে আনুষ্ঠানিক আয়োজন উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সেদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের। পাশাপাশি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
কিন্তু ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে ৮ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল চৌধুরী জানান, ১৭ মার্চের সব অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসজনিত কারণে সৃষ্ট বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান পুনর্বিন্যাস করা হয়।
‘মুক্তির মহানায়ক’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত সম্প্রচারের পর মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাণী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার অনুভূতি প্রকাশ ও তার লেখা কবিতা প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে পাঠ, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাপ্রধানদের ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়।
প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী প্রোগ্রামের শেষে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা থেকে পিক্সেল ম্যাপিংয়ের লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়।
সেই আয়োজনের পর জাতির জনকের জন্মদিনের সব অনুষ্ঠান ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি।
ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসও পালিত হয় ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে। টেলিভিশন, বেতার, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রচারের জন্য একটি বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান এবং অনলাইনে একটি কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে তরুণ প্রজন্মকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ‘শতবর্ষে শত পুরস্কার’ শিরোনামে একটি অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ২ লক্ষাধিক প্রতিযোগী।
২৫ মার্চে গণহত্যা দিবস পালন, স্বাধীনতা দিবস, মেহেরপুরের মুজিবনগর দিবস উদযাপন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তি দিবস, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন, জাতীয় শোক দিবস পালন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ প্রদানের দিনটি, জেল হত্যা দিবস অনলাইনে উদযাপিত হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জাতীয় সংসদের ‘বিশেষ অধিবেশন’ বসেছিল ৮ নভেম্বর। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টায় সংসদের বৈঠক আহ্বান করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাওয়া জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে সংসদে বঙ্গবন্ধুর জীবনের উপর আলোচনা করেন সংসদ সদস্যরা।
এই বিশেষ অধিবেশনই সংসদের ইতিহাসে প্রথম কোনো অধিবেশন যেখানে সংসদ কক্ষে ব্ঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল। এই অধিবেশনে স্মারক বক্তৃতা দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে ১০টি কর্মসূচি নিয়েছিল জাতীয় সংসদ।
মুজিববর্ষে নানা গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ
মুজিববর্ষ উপলক্ষে নানা গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
সেসব গ্রন্থের গ্রন্থের বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে; জাতির পিতার ঐতিহাসিক নির্বাচিত ভাষণসমূহের সঠিক ও বিশুদ্ধ পাঠ নির্ণয় এবং টিকা-ভাষ্য রচনা, জাতির পিতাকে নিবেদিত প্রবন্ধ, লোককবিতা, ছড়া, গল্প সংকলন, কিশোর বয়সীদের উপযোগী বঙ্গবন্ধুর প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ, জাতির পিতার সম্মতি ও অনুমোদনে তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রণীত আইনসমূহের সংকলন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি প্রকাশিত ‘কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর’ শিরোনামের স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন।
একই মলাটের মধ্যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ‘কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর’ ইংরেজিতে ‘ভয়েস অব মিলিয়ন্স’ স্মরণিকার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে; শেখ রেহানার কবিতা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী, বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত সচিত্র জীবনী।
এছাড়া রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্মরণীয় বাণী, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের স্মরণীয় উক্তি, বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর লিখিত গ্রন্থসমূহের পরিচিতি।
আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিশুদের উপযোগী বই, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার সংকলনসহ তাকে নিয়ে একটি কফি টেবিল বই প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শকে তুলে ধরে দেশ বিদেশের পাঠকদের জন্য বঙ্গবন্ধুর জীবনী প্রকাশের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল।
তবে সে উদ্যোগ আর এগোয়নি, পরিকল্পনাতেই থমকে আছে।
কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ২০২১ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা বঙ্গবন্ধুর নামে উৎসর্গ করবে এবং থিম কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচন করেছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরের আয়োজনও বাধাগ্রস্ত
বঙ্গবন্ধুকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৭৭টি দূতাবাসে ২৬০টিরও বেশি অনুষ্ঠানের আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
এর মধ্যে ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তর, জেনিভায় জাতিসংঘ দপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, ব্রাসেলসে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদরদপ্তর ও প্যারিসে অবস্থিত ইউনেস্কোর সদরদপ্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ‘শোষণহীন বিশ্ব’ গড়ে তোলার স্বপ্নকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রধান প্রধান আট শহরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। জাতিসংঘসহ বিশ্বের নানা দেশে বঙ্গবন্ধুকে নানা আয়োজনের পরিকল্পনাও করা হয়েছিল।
জন্মশতবার্ষিকী বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল চৌধুরী এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেসব কার্যক্রমও সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।”
চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আহ্বান করা হয়েছিল লোগো ও পোস্টার ডিজাইন প্রতিযোগিতার।
বঙ্গবন্ধুর অসামান্য জীবন ও আদর্শকে দেশ-বিদেশে তুলে ধরতে চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে স্ক্রিপ্ট ও নির্মাণের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছিল। চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র মিলিয়ে মোট ২৩০টি প্রস্তাব জমা পড়েছিল বলে জানায় জন্মশতবার্ষিকী বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর ৬৭টি তথ্যচিত্রের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছিল কমিটি।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিদিনকার ঘটনাপঞ্জি তুলে ধরে নির্মিত টিভি স্পট ‘বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন’ নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোতে।
করোনাভাইরাসে সংক্রমণের মাত্রা কমে এলে বড় পরিসরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আশা করছেন কামাল চৌধুরী।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ইতোমধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের এ সংক্রান্ত এক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বছরজুড়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে মুজিববর্ষ উদযাপিত হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনার চর্চা চলমান থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন কামাল চৌধুরী।
“এ বছর ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে আমাদের মুজিববর্ষ পালন করতে হয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে নানা আয়োজন ছিল আমাদের। তবে জাতির জনককে শ্রদ্ধা জানানোর এই প্রক্রিয়া তো কখনও থমকে যাবে না। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের অগ্রযাত্রাকে চলমান রাখতে হবে।”