প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তর ঘোষণাতেই আটকে

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের সরকারি ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি অর্ধযুগ পরও।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2020, 02:41 PM
Updated : 27 Nov 2020, 05:41 PM

অধিদপ্তর হলে প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানসহ তাদের অধিকার সুরক্ষায় আরও অগ্রগতি হবে বলে মনে করছেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।

তারা বলছেন, বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তর ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের সেবা সংক্রান্ত কাজগুলো হয়ে থাকে। চিকিৎসা সেবার জন্য প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন পরিচালিত প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে যেতে হয়। আবার প্রতিবন্ধী কার্ড ও ভাতার জন্য দৌড়াতে হয় অন্য জায়গায়।

এই প্রক্রিয়ায় হয়রানির পাশাপাশি বিভ্রান্তিতে পড়ে অনেকে তার অধিকারটুকু বুঝে নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সেখানে অধিদপ্তর হলে এক জায়গায় সব কাজ হত, প্রতিবন্ধীরা সহজে সেবা পেতেন।

এদিকে সারা দেশে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে যারা চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি ও কাউন্সেলিং সেবা দেন, তাদের অনেকের চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় কিছু দিন পর অন্যত্র চলে যান। অধিদপ্তর হলে তাদের চাকরি স্থায়ী ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে এই সংকটের সুরাহা হত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০১০ সালে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে পূর্ণাঙ্গ অধিদপ্তরে রূপ দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

পরে ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তরে রূপান্তরের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। সে সময় একটি নামফলকও উন্মোচন করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকমণ্ডলীর দ্বিতীয় সভাতেও প্রতিষ্ঠানটিকে অধিদপ্তর করার সিদ্ধান্ত হয়।

এক দশকের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি অধিদপ্তরে রূপ না পেলেও তৎপরতা ‘অনেক দূর’ এগিয়েছে বলে জানিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

আর  অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবেন বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ইমাম উদ্দিন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় এর কার্যক্রম শুরু হলে অনেক জনবলের প্রয়োজন হবে, সেখানে আমরা প্রাধান্য পাব।

“তখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে প্রতিবছর আলাদা বাজেট করতে হবে। যেটা সরকারিভাবে হয় না আমাদের জন্য। ফলে আমাদের উন্নয়ন হবে। আমাদের দায়িত্বটা তখন তাদের উপর চলে যাবে। একটা জবাবদিহির জায়গা তৈরি হবে।

“অধিদপ্তর হলে দায়িত্ব চলে যাবে সরকারের হাতে। ফলে উন্নয়নটা হবে। একই জায়গা থেকে সব সুবিধাগুলো আমরা পাব।”

সমাজসেবা অধিদপ্তর যে ৫১টি বিষয় নিয়ে কাজ করে, সেখানে প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি ‘খুবই নিগৃহীত’ বলে অভিযোগ করেন চাকরিপ্রত্যাশী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েট কাউন্সিলের আহ্বায়ক আলী হোসাইন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, নারীদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর নেই।”

তিনি বলেন, “শিক্ষাসহ বিভিন্ন জায়গায় আমাদের অনেক অনিয়ম হচ্ছে। অধিদপ্তর থাকলে সেটি শুধু আমাদের নিয়ে কাজ করত। আমাদের অধিকারগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হত এবং তাদেরকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজে লাগাতে পারতাম।

“সমাজসেবা অধিদপ্তর এমনভাবে কাজ করে যেখানে আমাদের অধিকার মোটেই সুরক্ষিত হয় না। নিয়োগ বাণিজ্য হয়, প্রতিবন্ধীদের জায়গায় অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়।”

অধিদপ্তর হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন আলী হোসাইন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “একটি অধিদপ্তরে কমপক্ষে সাত হাজার জনবলের প্রয়োজন হয়। এটা করলে পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা জনসম্পদে পরিণত হবে।

“আমরা গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের কর্মক্ষেত্র নিয়ে কোনো কার্যক্রম হয়নি। কোটা বাতিলের পর তিনি আমাদের বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়োগের কথা বলেছিলেন। সেটারও কিছুই হয়নি।”

প্রতিবন্ধীদের চাকরির দাবিতে সোচ্চার আলী হোসাইন বলেন, “পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষিত প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারছে না।”

অধিদপ্তর হলে প্রতিবন্ধীরা বিশেষ নজর পাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ-পিএনএসপির সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় অনেক কাজের পাশাপাশি এ কাজটা দেখেন। জাতিসংঘের সিআরপিডির আর্টিকেলেও আলাদা সংস্থার কথা বলা হয়েছে, যারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করবে।

“সে রকম কোনো সংস্থা আমরা দেখতে পাই না। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন সে জায়গায় নাই। তারা তাদের মতো কাজ করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করতে হলে সেখানে তাদের আধিক্য থাকতে হবে, যেটা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে নেই। যে পলিসি বা উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়, সেখানেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যুক্ত নাই। অধিদপ্তর হলে এ বিষয়গুলোর প্রতিফলন আমরা দেখতে পেতাম।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিছুজ্জামানও স্বীকার করেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ফাউন্ডেশনকে পূর্ণাঙ্গ অধিদপ্তর করা উচিত।

কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন দিয়েছেন যে, প্রতি উপজেলায় একটি করে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র হবে। সেটি হলে জেলা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা ও বিভাগীয় পর্যায়ে একজন পরিচালক থাকলে কাজের তদারকিটা ঠিকমতো হবে।

“অধিদপ্তর হলে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্টাফদের চাকরি সরকারি হবে। তাদের ইনক্রিমেন্টও হবে। সুযোগ-সুবিধা না থাকায় আমাদের ১০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। চাকরিতে পদোন্নতি নাই, স্থায়ী না- এসব চিন্তা করে।”

অধিদপ্তরে রূপান্তরের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সব কাগজপত্র পাঠিয়েছি। তিনি আমাদের পৃষ্ঠপোষকমণ্ডলীর সভা আহ্বানের চেষ্টা করছেন, যেটা প্রধানমন্ত্রী প্রোভাইড করেন। প্রধানমন্ত্রী যদি জোর দেন তাহলে এটা দ্রুত হয়ে যাবে।”

অধিদপ্তরে রূপান্তরের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব দেওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতিতে এটি প্রশাসনিক উন্নয়ন সম্পর্কিত সচিব কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল।

“সেই কমিটি আবার তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছিল, তারা একটি সুপারিশ করেছিল। তারপর সেটা যখন প্রশাসনিক উন্নয়ন সম্পর্কিত সচিব কমিটিতে দেওয়া হল তখন ওই কমিটি এটার অনুমোদন করেনি।

“ওই কমিটির অনুমোদনের পর এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবে। আমরা সেটার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।”

জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের বিষয়ে আশাবাদী জানিয়ে সচিব বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তার আমলেই প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন হয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন হয়েছে।

“তিনি প্রতিবন্ধীবান্ধব, ওনার সময়েই এটি বাস্তবায়িত হবে বলে মনে করি।”