প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূল স্রোতে আনতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

প্রতিবন্ধীরা সমাজের মূল স্রোতে মিশে যেন সুস্থভাবে বাঁচতে পারে সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 April 2014, 09:04 AM
Updated : 2 April 2014, 01:29 PM

“অটিস্টিক এবং প্রতিবন্ধীদের আজীবন থাকা এবং পরিচর্যা ব্যবস্থা ভবিষ্যতে সরকার করতে চায়,” সপ্তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বলেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বুধবার এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবন্ধীদের প্রতি দায়িত্ব যেমন তাদের অভিভাবকদের রয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রেরও রয়েছে।

প্রতিবন্ধীদের ভাগ্যোন্নয়নে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ইনশাল্লাহ্ আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অটিস্টিক শিশুদের জাতীয় জীবনের মূলধারায় যুক্ত করতে পারব।”

অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাসিমা বেগম নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “আমি সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের পাশাপাশি একজন অটিস্টিক শিশুর মা হিসাবে এখানে দাঁড়িয়েছি। আমার সন্তানের বয়স ২৮, সে এখানে উপস্থিত রয়েছে।”

“আমরা অটিস্টিক সন্তানদের মায়েরা সর্বদা দোয়া করেছি- আমাদের মৃত্যুর আগে যেন আমাদের সন্তানদের মৃত্যু হয়,” বলেন তিনি।  

প্রতিবন্ধীদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে প্রধানমন্ত্রী এবং তার মেয়ে সায়মা হোসেন পুতুলের উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদও জানান নাসিমা।

এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অটিস্টিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুর বাবা-মা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকেন। বিশেষ করে তাদের অবর্তমানে এই শিশুরা তাদের সম্পদের ব্যবস্থাপনা কিভাবে করবে, তা নিয়ে চিন্তা করেন।

“এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমরা অটিস্টিক ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করেছি।”

এর মাধ্যমে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যই সব অর্থ ব্যয় করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

“এই ট্রাস্টের মাধ্যমে আমরা এমনভাবে প্রতিষ্ঠাগুলো গড়ে তুলতে চাই, যেন এই শিশুরা নিরাপদে সেখানে থাকতে পারে। তাদের আজীবন থাকা এবং পরিচর্যা ব্যবস্থা ভবিষ্যতে আমরা করতে চাই।”

 

প্রতিবন্ধী শিশুদের ঘরে আটকে না রাখতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে হাসিনা বলেন, “অনেক সময় তাদের ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। বাবা মা তাদের লুকায়।

“আসলে লুকানো উচিত না। তারাও এই সমাজের। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাদের প্রতি মায়া, মমতা, দায়িত্ববোধ সকলের থাকতে হবে।”

প্রতিবন্ধী শিশুদের মেধার বিকাশের সুযোগ করে দিতে সকলের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিজের নেয়া উদ্যোগের কথাও বলেন হাসিনা।

অটিস্টিক শিশুদের ছবি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নববর্ষ এবং ঈদ কার্ড তৈরির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০ থেকে ২৫ হাজার কার্ড ছাপা হয়। তাদের সন্মাননাও দেয়া হয়। আগামীতে তিনজনের ছবি নিয়ে কার্ড তৈরি করা হবে।

দেশের প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক ব্যক্তিদের সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তর’ এ রূপান্তরের ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রতিবন্ধীদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের দেশে হয় না। আমরা এবার জাতীয়ভাবে করবো। খেলাধূলায় তারা অত্যন্ত পারদর্শিতা দেখাতে পারে, যা সুস্থরা পারে না।”

সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এজন্য গত অর্থ বছর থেকে সরকার সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা সনাক্তকরণ জরিপ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান কাজ দ্রুতই শেষ হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন।

একজন মনোবিশেষজ্ঞ হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী সায়মা হোসেন পুতুলের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজমসহ নিউরো-ডেভেলপমেন্টের ওপর কাজ করার বিষয়টি উল্লেখ করে হাসিনা বলেন, “বিশেষ করে তার কাছ থেকেই জানতে পারি, এই বিষয়ে।”

সায়মা হোসেন পুতুলের উদ্যোগে জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে প্রতিবন্ধী শিশুদের ওপর একটি প্রস্তাব দেয়া এবং ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর তা গৃহীত হওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।

‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ এবং ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ পাশ করা এবং এই দুই আইনের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।

১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি তাদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করতে ৬৪টি জেলয় ৭৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালুর কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রতি জেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের সাথে একটি করে অটিজম কর্নার চালু হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ কার্যক্রম উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে।

প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে একটি করে প্রতিবন্ধী কর্মজীবী পুরুষ ও মহিলা হোস্টেল, অটিজম রিসোর্স সেন্টার ও অটিস্টিক স্কুল চালু, ইশারা ভাষার উপর প্রশিক্ষণ দেয়া এবং অটিস্টিক শিশুর মায়েদের জন্য প্রাত্যহিক লালন-পালনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু করার কথাও বলেন শেখ হাসিনা।

রাজধানীর মিরপুরে একটি মাল্টিপারপাস প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, “এ কমপ্লেক্সে বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ ২৭৫ জন প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক ব্যক্তির জন্য শেল্টার হোমের ব্যবস্থা থাকবে।”

অটিস্টিক শিশুদের মাঝে প্রধানমন্ত্রী

সরকারি অনুষ্ঠান হলেও এদিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে অটিস্টিক এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের ছিল অবাধ বিচরণ।

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পৌছে প্রথমেই জাতীয় প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স এবং প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তরের ফলক উন্মোচন করেন।

সেসময়, তানভীর নামের ৯/১০ বছরে এক প্রতিবন্ধী শিশু প্রধানমন্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রীর পাশে তখন সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী এবং প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রীর মাঝে গিয়ে দাঁড়ায় তানভীর। ফলক উন্মোচনের পর সকলে মোনাজাতের জন্য হাত তুললে তানভীরও হাত তোলে। শেখ হাসিনা মঞ্চে তানভীরকে তার পাশে বসান।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার এক পর্যায়ে তানভীর প্রধানমন্ত্রীর ডায়াসের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আসো দাঁড়াও।”

 

তানভীর কিছুটা চঞ্চল হয়ে এদিক সেদিক তাকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যেওনা, দাঁড়াও।”

নিজের ডায়াস সাজানো ফুল থেকে একটি তানভীরের হাতে তুলে দেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতা শেষ করে ধন্যবাদ দেওয়ার আগে ডায়াস থেকে সরে দাঁড়িয়ে তানভীরকে জায়গা করে দিয়ে বলেন, “তোমার নাম বল।”

“ও একটু কথা বলবে,” সবার উদ্দেশে বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তানভীরকে মাইকে কথা বলতে বারবার অনুরোধ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বলো নাম বল, নাম বলবে না ?”

তানভীর কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে শেখ হাসিনা তাকে বলেন, “চলো ছবি আঁকি।”

এরপর, মিলনায়তনে উপস্থিত সবার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সবাইকে ধন্যবাদ। ও (তানভীর) বলছিল, মাইকে কথা বলবে। আমি দিলাম। কিন্তু ..।

“মন খারাপ করে না,” মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তানভীরকে বলেন প্রধানমন্ত্রী।

এরপর, মঞ্চে উঠে গিয়ে অটিস্টিক শিশুরা প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেন।  

পরে, অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেন।