চলতি বছরের জন্য যে পরিমাণ তহবিল চাওয়া হয়েছিল, করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ১০ মাসে এসেছে তার মাত্র ৫৪ শতাংশ। আগের তিন বছরে প্রত্যাশিত তহবিলের ৭২ শতাংশের বেশি পাওয়া গিয়েছিল।
এই তহবিল আহ্বান ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন স্ট্র্যাটেজিক এক্সিকিউটিভ গ্রুপ মনে করছে, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধাক্কাই এবছর তহবিল সংগ্রহে এই নাজুক দশার মূল কারণ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে গ্রুপের পক্ষ থেকে এক ইমেইলে বলা হয়েছে, “অভূতপূর্ব বৈশ্বিক মহামারীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পুরো বিশ্ব। অর্থনীতি সঙ্কুচিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশকে স্বাস্থ্য সেবা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজসহ বিভিন্ন খাতে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে।”
তহবিলের এই সঙ্কট অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের আর্থিক চাপ তৈরি হবে বলে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, এভাবে ফান্ড কমতে থাকলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য ’বোঝা হয়ে যাবে’।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পোর সঙ্গে এই গ্রুপের কো-চেয়ার হিসাবে রয়েছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) আবাসিক প্রতিনিধি স্টিভেন করলিস এবং আইওএম বাংলাদেশের চিফ আব মিশন গিওর্গি গিগাওরি।
চলতি বছর সর্বশেষ জেআরপিতে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৭ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাস মোকাবেলার অংশ হিসাবে তার সঙ্গে আরও ১৮ কোটি ১৪ লাখ ডলার যোগ করা হয়।
জাতিসংঘের অফিস ফর দি কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের (ওসিএইচএ) তথ্য বলছে, দুই ভাগে জেআরপিতে মোট ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে অক্টোবরের ৩১ তারিখ পর্যন্ত ফান্ড এসেছে ৫৭ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। চলতি বছরের দুই মাস বাকি থাকতে পরিকল্পনার মাত্র ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ মিটেছে।
এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা যেন অব্যাহত থাকে সে আহ্বান এসেছে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে।
ফান্ড কমে আসার মধ্যে অক্টোবরের ২২ তারিখে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় দাতাদের ভার্চুয়াল সম্মেলন আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা।
ওই সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় প্রায় ৬০ কোটি ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও দেশ।
তহবিল কমার প্রসঙ্গ টেনে ওই সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিশনার ইয়ানেস লেনারচিচ বলেন, “এই সঙ্কট যেন বিস্মৃত ট্রাজেডিতে পরিণত না হয়, আমাদেরকে তা নিশ্চিত করতে হবে।”
এছাড়া আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া আরও চার লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ে কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত ১১ মার্চ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অবরুদ্ধ রাখা হলেও তার মধ্যেই সংক্রমণ ঘটেছে। অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে কেবল পানি, স্যানিটেশন ও খাবার বিতরণের সঙ্গে জড়িত এনজিওগুলোর কার্যক্রম সেখানে চালু আছে।
তহবিলের হাল
জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর ও আইওএম যৌথভাবে কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে তহবিল চেয়ে আসছে।
জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) নামে ওই সহযোগিতা কার্যক্রমে ২০১৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর আর্থিক সহায়তা নিয়ে আসছে ওই তিন সংস্থা।
ওই বছরের অগাস্টে রোহিঙ্গা ঢল নামার পরপর প্রথম জেআরপি করা হয়, যাতে চার মাসের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৩ কোটি ৪১ লাখ ডলার। তার মধ্যে ৭৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩১ কোটি ৭২ লাখ ডলার এসেছিল দাতাদের কাছ থেকে।
ওই সময়ে জেআরপির বাইরে দাতাদের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় বাংলাদেশে আরও ২২ কোটি ডলারের ফান্ড এসেছিল। সব মিলিয়ে তহবিলের আকার ৫৩ কোটি ৬৫ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছিল।
এরপর ২০১৮ সালের জন্য করা জেআরপিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৫ কোটি ৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে এসেছিল ৬৮ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, যা মোট পরিকল্পনার ৭২ শতাংশ।
আগের দুই জেআরপির ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালেও পরিকল্পনার ৭৫ শতাংশ ফান্ড এসেছিল দাতাদের কাছ থেকে। প্রাক্কলিত ৯২ কোটি ৫ লাখ ডলারের মধ্যে ৬৯ কোটি ১ লাখ ডলার পাওয়া গিয়েছিল।
জেআরপির বাইরে ২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় বাংলাদেশে ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ডলার আসে। সব মিলিয়ে গত বছর রোহিঙ্গাদের জন্য পাওয়া তহবিলের আকার দাঁড়ায় ৮৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলারে।
প্রথম তিনটি জেআরপির ৭২ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত তহবিল হাতে পাওয়া গেলেও এবার ১০ মাসে এসেছে ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর জেআরপির বাইরে চলতি বছর এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে এসেছে ১৪ কোটি ৯১ লাখ ডলার।
তিন বছরের মাথায় রোহিঙ্গা সঙ্কট থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ ক্রমান্বয়ে সরে যাচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তা তো যাচ্ছেই। প্রাথমিকভাবে যে অগ্রাধিকার তাদের দিক থেকে ছিল, তা এখন আর নেই।”
তহবিলের বিষয়ে এক প্রশ্নে মোমেন বলেন, “বাংলাদেশের নামে তারা যে ফান্ড আনে, কত টাকা আনে, কোথা থেকে আনে, কীভাবে খরচ করে- তার কোনো কিছুই আমাদেরকে জানায় না।
”তারা রোহিঙ্গাদের পেছনে কত টাকা খরচ করে আর কত টাকা নিজেদের পেছনে খরচ করে তাও আমরা জানি না। অথচ টাকা আনছে বাংলাদেশের নামে।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি সরে যাওয়ায় বিষয়ে এক প্রশ্নে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন স্ট্র্যাটেজিক এক্সিকিউটিভ গ্রুপ বলছে, সঙ্কটের ‘সত্যিকারের টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান’ নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ এবং সহযোগীরা কাজ করে যাবে।
সামনের দিনের চ্যালেঞ্জ
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলে থাকায় সংকট দীর্ঘায়িত হলেও ক্যাম্পের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জরুরি খাদ্য, পানি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, আশ্রয়সহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন মিটিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার ও দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো।
প্রত্যাবাসন শুরু হলে মিয়ানমারে ফেরত গিয়ে রোহিঙ্গারা যাতে আবার সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, সেজন্য তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে জোর দেওয়ার কথা বলছে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা।
সেই দিকটি মাথায় রেখে পরবর্তী পরিকল্পনা করার কথা উল্লেখ করে স্ট্র্যাটেজিক এক্সিকিউটিভ গ্রুপ বলেছে, “একদিকে স্বাস্থ্যসেবা, পানি, স্যানিটেশন ও খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ মহামারী নতুন নতুন প্রয়োজনীয়তা হাজির করেছে, কিন্তু রোহিঙ্গা শিশু ও যুবকদের বড় পরিসরে শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়াও প্রয়োজন।
”যেটা গঠনমূলক ভবিষ্যতের প্রতি তাদেরকে নিবদ্ধ রাখবে এবং পরিস্থিতি ভালো হলে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পর নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য তাদের দক্ষ করে তুলবে।”
কিন্তু নতুন নতুন উদ্যোগে ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে তহবিল কমলে বাংলাদেশের উপর আর্থিক চাপ আরও বাড়াবে।
পাশাপাশি রোহিঙ্গারা ক্রমান্বয়ে মানব পাচার, উগ্রবাদ, মাদক চোরাচালান কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লে এ অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে বলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সতর্ক করে আসছে বাংলাদেশ।
সেপ্টেম্বরে আসিয়ান রিজিওনাল ফোরামের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, “সন্ত্রাসীদের কোনো সীমান্ত নেই। আমাদের ভয় হলে, যদি এ সমস্যাটির দ্রুত সমাধান না করা হয়, তবে এটি উগ্রপন্থার জন্ম দিতে পারে।”
তহবিল কমলেও ‘পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অবস্থা’ বাংলাদেশের আছে বলে আশাবাদী হতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশে যেহেতু ডানপন্থি সরকার আছে, যদি ইউরোপে বলি, এমন কি ফ্রান্স, আমেরিকায় ডানপন্থি সরকার থাকাতে এসব ব্যাপারে কখনো বড় আকারের উৎসাহ তাদের ছিল না। তার উপর মহামারী আসায় ফান্ড দেওয়ার সে রকমের অবস্থায় তারা নেই।
”তাছাড়া বাংলাদেশ তিন বছর যখন সামাল দিয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ভালো আছে, তারা অনেকটা বুঝে নিয়েছে যে বাংলাদেশ সামাল দিতে পারবে।”
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “তিন বছর আমরা তো সামাল দিয়েছি, একশ ভাগ ফান্ড তো কখনোই আসেনি, তারপরও তো আমরা সামাল দিয়েছি।
”সামাল দিয়েছি এমনভাবে, পৃথিবীর অনেকে অবাক হয়ে গেছে, এত সুন্দরভাবে এত বড় গোষ্ঠীকে আমরা কীভাবে রাখতে পারলাম। আমি মনে করি না যে সামাল দিতে পারবে না। চাপ পড়বে হয়ত।”
প্রত্যাবাসন নিয়ে উচ্চকণ্ঠ বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।
গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হননি ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা।
এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা যোগানোর পাশাপাশি তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ওপরই বাংলাদেশ বেশি জোর দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের মূল বক্তব্য হল- রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে হবে। ইউএনএইচসিআর অনেক কাজ করছে, কিন্তু কতজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে?”
বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বললেও কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় বাংলাদেশের হতাশাও ক্রমশ বাড়ছে।
সম্প্রতি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “সবাই বলে, কিন্তু একটা লোকওতো এখনও যায় না। তিন বছর পার হয়ে গেছে একজনও যায়নি। যদিও মিয়ানমার দাবি করে, কিছু কিছু লোক নাকি একলা একলা চলে গেছে মিয়ামনারে।”
৮ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচনের পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের আশ্বাস দিয়েছে চীন।
মিয়ানমারের প্রধান মিত্র দেশ চীন বলছে, প্রথমত রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে এবং পরে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রী পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তা সম্ভব হলে প্রত্যাবাসন শুরুর আরও একটি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলে আশাবাদী অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
তিনি বলেন,”অনেকে আশা করছে, মিয়ানমার নির্বাচনের পরে হয়ত একটা সমাধান করতে চাইবে, চীনও অস্থির হয়ে গেছে, একটা সমাধান তারাও চাইছে।”