রোহিঙ্গাদের এখনকার হিসাবটিই সঠিক: অতিরিক্ত প্রত্যাবাসন কমিশনার

দুই বছর আগে প্রাথমিক গণনায় সাড়ে ৯ লাখের মত রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হলেও পরে জরিপের ভিত্তিতে সাড়ে ৮ লাখের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, সেটিই ‘সঠিক’ বলে জানিয়েছেন সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু দ্দৌজা।

হাসান বিপুলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2020, 06:55 PM
Updated : 8 Oct 2020, 07:43 PM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা এই রোহিঙ্গাদের বর্তমান সমস্যাগুলোর পাশাপাশি সঙ্কট নিরসনে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন এই সরকারি কর্মকর্তা।

গত কয়েক দশকে মিয়ানমারে দমন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনের গ্রামে গ্রামে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান হিসেবে বর্ণনা করে আসছে।

এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। জাতিসংঘের নেতৃত্বে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের এই নাগরিকদের জরুরি চাহিদাগুলো পূরণ করার চেষ্টা করে আসছে।   

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু দ্দৌজা।

সেখানে জরুরি সহায়তার কাজে থাকা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় লাখ ৫৭ হাজার রোহিঙ্গা জনসংখ্যার হিসাব দিয়েছিল।

সেই সংখ্যা আট লাখ ৬০ হাজারে নেমে এসেছে এ বছরের জুলাই মাসের হিসেবে। অথচ এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলায় বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছে প্রায় পৌনে এক লাখ শিশু।

একেবারে শুরু থেকে সেখানে দায়িত্ব পালন করে আসা সামছু দ্দৌজা বলেন, “প্রথম দিকে প্রচুর লোক একসাথে এসেছে। আমরা একটা হিসাব করেছি আমাদের কর্মকর্তাদের দিয়ে। আইএসসিজি করেছে, পপুলেশন মুভমেন্ট- তারা একটা হিসাব করেছে, এর সাথে আমাদের পাসপোর্ট অধিদপ্তর একটা জরিপ করেছে। সেখানেও একটা সংখ্যা তারা বলেছে।

"(সেই হিসাবে) এই সংখ্যা বাড়ার কথা। (কিন্তু) রোহিঙ্গারা দেখা গেছে তিন-চার বার কোথাও কোথাও রেজিস্ট্রেশন করেছে খাদ্য সহায়তা বা অন্য কিছুর জন্য। অথবা আগে এক ক্যাম্পে ছিল, পরে অন্য ক্যাম্পে গেছে।"

অতিরিক্ত প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, "আগের ওইসব ডেটায় নানা অসঙ্গতি ছিল। ফলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইউএনএইচসিআর মিলে একটি যৌথ যাচাই প্রক্রিয়া চালু করে। এতে করে প্রকৃত তথ্য পাওয়া গেছে।"

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় (ইউএনএইচসিআর) বলছে, আগে যে নয় লাখ ১৪ হাজার ৯৯৮ জন রোহিঙ্গার ‘আনুমানিক’ হিসাব ছিল, সে তুলনায় এখনকার ৮ লাখ ৬০ হাজার ৬৯৭ জনের হিসাবে পার্থক্য ৬ শতাংশেরও কম। তাদের অভিজ্ঞতায় বিশ্বব্যপী শরণার্থীদের বড় সংখ্যায় স্থানান্তরের বেলায় সংখ্যার এই পার্থক্য ‘খুব বড় কিছু নয়’।

চলতি বছরের ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনে ৮ লাখ ৬০ হাজারের সর্বশেষ ওই সংখ্যাটি পাওয়া গেছে বলে ইউএনএইচসিআরের ভাষ্য।

২০১৭ সালের অগাস্ট থেকে ব্যাপক সংখ্যায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময়টিতে সঠিক সংখ্যা নিরূপণের চেয়ে তাদের জন্য খাবার এবং আশ্রয় নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বলে মন্তব্য করেন সামছু দ্দৌজা।

তিনি বলেন, "ইউরোপে বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঁচ-দশজন করে আশ্রয় দেয় এবং তাদের সুন্দরভাবে রেজিস্ট্রেশন করায়। ওইভাবে এখানেও রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে মানুষ না খেয়ে মারা যেত। একেকদিন ৩০-৪০ হাজার করেও মানুষ প্রবেশ করেছে এখানে।

“আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন ... আমরা অন্তত গর্ব করে বলতে পারি, কেউ মারা যায়নি না খেয়ে।"

ছবি: রয়টার্স

চ্যালেঞ্জ

২২তম বিসিএস-এ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সামছু দ্দৌজা ২০১৭ সালে ব্যপক সংখ্যায় রোহিঙ্গা প্রবেশের আগে থেকেই শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে কাজ করছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতার পর এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ জানতে চাইলে আইনশৃঙ্খলার কথাই বলেন তিনি।

"বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিসপূর্ণ দেশ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে ১২ শর বেশি লোক বসবাস করে। আমাদের আবাসভূমির সঙ্কট রয়েছে। সরকার সদয় হয়ে মানবিক বিবেচনায় সাড়ে ছয় হাজার একর জায়গা দিয়েছে (রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য) যেটা প্রায় ২৬-২৭ বর্গ কিলোমিটার।”

“এইটুকু জায়গায় প্রায় এক মিলিয়ন লোক এখন বাস করে। এখানে কোনো বহুতল স্থাপনা নেই। প্রতি বর্গকিলোমিটারে কোনো কোনো অংশে ৩০-৪০ হাজার লোক বাস করে, কোনো কোনো ক্যাম্পে এই সংখ্যা আরও বেশি।"

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘যথেষ্ট সাহসীকতার সঙ্গে’ কাজ করলেও এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় শৃঙ্খলা রক্ষা করাই ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ বলে মন্তব্য করেন সামছু দ্দৌজা।

কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দলকে সেপ্টেম্বরের শুরুতে নোয়াখালীর ভাসানচরের আশ্রয় শিবির ঘুরিয়ে দেখানো হয়।

ভাসানচর

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার পারিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সেটাও কী একটি চ্যালেঞ্জ?

সামছু দ্দৌজা বলছেন, রোহিঙ্গারা সেখানে ‘যেতেই’ চায়।

"কিছুদিন আগে ৪০ জনকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ক্যাম্প ইনচার্জ সূত্রে খবর পেলাম যে, সেখান থেকে ফিরে তিন-চারজন বলেছেন, তারা যেতে চান না। এটা নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে, আসলে তারা রাজি আছে। তারা এই ব্যাপারে পজিটিভ।"

রোহিঙ্গাদের মনোভাব বোঝার জন্য তাদের আলাদা করে ডেকে কথা বলতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দেন এই সরকারি কর্মকর্তা।

"বিভিন্ন হিউম্যান রাইটস আর্গানাইজেশন বিভিন্ন সময়ে বলে যে, এই হচ্ছে সেই হচ্ছে। আমরা তাদের বলি, তোমরা মিয়ানমারে যাও, তাদেরকে কথাগুলো বলো। আমরা আশ্রয় দিয়েছি, আমরা তাদেরকে খাবার দিয়েছি। আর তোমরা আমাদের ভুল ধরছ। আর যে তাদের মেরে ফেলছে, তাদের নিচ্ছে না, তাদেরকে তোমরা কোনো চাপই দিতে পারতেছ না।

"এখানে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরাও এসেছেন। আদেরকে আমরা জিজ্ঞেস করেছি, তোমরা মিয়নমারে গিয়েছ কি না? তারা বলে যে, আমাদের তো সেখানে যেতে দেয় না।"

মিয়ানমার তার দেশের এই নাগরিকদের ফেরত নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকেই চুক্তি করেছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। তারা সেজন্য প্রস্তুত বলে দাবি করে এলেও রাখাইনে এখনও সেই অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলে আসছে। আর মিয়ানমারের কথায় রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় প্রত্যাবাসনের দুই দফা চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

ভাসানচরে নৌ বাহিনীর সহায়তায় প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়ের ব্যবস্থা সম্পর্কে সামছু দ্দৌজা বললেন, "থাকা খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা আছে, কিছু লাইভলিহুড অ্যাকটিভিটিজ আছে, মাছ চাষ আছে। আলাদা কিচেনের ব্যবস্থা আছে। এই ক্যাম্পের তুলনায় সুবিধা বেশি। যেহেতু ওটা পরিকল্পিত আর জায়গাটাও বড়।"

ইউএনএইচসিআরের উখিয়া আইসোলেশন সেন্টার। ছবি: আবদুর রহমান

কোভিড-১৯

দেশে প্রথম কারোনাভাইরাস রোগী শনাক্তের প্রায় আড়াই মাস পরে প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এখন পর্যন্ত ১১ হাজারের মত পরীক্ষা করে সেখানে ২৭০ জনের রোগী শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছেন আট জন। সেরে উঠেছেন একশর বেশি।

দেশে গড়ে শনাক্তের হার যেখানে ২০ শতাংশের মত, সেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওই হার আড়াই শতাংশের কম বলে জানালেন অতিরিক্ত প্রত্যাবাসন কমিশনার।

ক্যাম্পে শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর জন্য ৫০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ক্যাম্পের দুটি ট্রানজিট সেন্টারকে কোয়ারেন্টিন সেন্টারে রূপান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি ‘উইমেন ফ্রেন্ডলি স্পেস’ এবং শিশুদের লার্নিং সেন্টারগুলোকেও কোয়ারেন্টিন সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

উখিয়ার স্থানীয় লোকজনও এখন সেখান থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে বলে জানালেন সামছু দ্দৌজা।

“আমাদের রেফারেল যেহেতু কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, সেখানে কাজ করার জন্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করেছি। ইউএনএইচসিআর ১০টি আইসিইউ বেড করেছে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে, আটটি এইচডিইউ করেছে, ইউনিসেফ অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েছে।”

ক্যাম্পের মত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ‘ডিসটেন্সিং’ মানা ‘এক কথায় অসম্ভব’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই অন্যান্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছ। পাশাপাশি একান্ত জারুরি না হলে ক্যাম্পে যাতায়াত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

দক্ষতার উন্নয়ন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাস্তবতায় স্থানীয় লোকজনের অনেকের কর্মসংস্থান হলেও তাদের কারিগরি দক্ষতার উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন সামছু দ্দৌজা।

কক্সবাজার এলাকায় দীর্ঘদিন ঘরে কাজ করা এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, "উখিয়া টেকনাফ তো বরাবরই একটু রক্ষণশীল এলাকা। সেখানে যখন আমি দেখি স্থানীয় মেয়েরা ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে কাজে যাচ্ছে, দেখতে খুবই ভালো লাগে।"

কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে অনেক বিদেশি ত্রাণকর্মী নিজেদের দেশে ফিরে গেছেন। এই মহামারী না এলেও সেটি ঘটত বলে মনে করেন অতিরিক্ত প্রত্যাবাসন কমিশনার।

তিনি বলেন, “আমাদেরও দাবি ছিল ধীরে ধীরে বড় পদগুলোয় যেন এদেশের লোকজন দায়িত্ব নেয়।”

তার মতে, মাঠ পর্যায়ের স্থানীয় কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে পারলে এই কর্মীরা ভবিষ্যতে দেশের বাইরেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে চাকরি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।

“আমরা তো এক মিলিয়ন লোকের দায়িত্ব নিয়েছি। দেশের বাইরে এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়ার বেলাতেও আমাদের একটা রেশিও থাকা উচিৎ। আমি মনে করি এটা আমাদের রাইট।”