পরীক্ষা না হওয়ায় খুশি, তবে ভাবনাও আছে

বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হবে না, এটা শুনে খুব খুশি গাজীপুর শ্রীপুরের কাওরাইদ কে এন উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আসিফ রবিন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2020, 03:26 PM
Updated : 21 Oct 2020, 04:12 PM

“আজকে থেকে দুঃশ্চিন্তা কিছুটা কমল৷ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আমাদেরকে বুঝতে পেরেছেন, তাই ধন্যবাদ তাকে,” প্রতিক্রিয়া এল তার কাছ থেকে।

কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হল এই সময়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছে ঢাকার পাশের জেলার এই শিক্ষার্থী।

“আমি গণিতে অনেক দুর্বল। বিশেষ করে বীজগণিত কিছুই পারি না। কোনো ক্লাস করতে পারিনি, তাই খুব ভয়ে ছিলাম এবার কীভাবে পাস করব?”

করোনাভাইরাস মহামারীকালে এইচএসসি, জেএসসি, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের পর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি সরকার।

বুধবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসে বলে দেন- “কোনো পরীক্ষা নয়, এবারের যে পরিস্থিতি, কোনো পরীক্ষা নয়। এবার কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে না।”

শীতে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে জনসমাগম ঘটানোর মতো কাজ এড়াতে চায় সরকার। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনলাইন ক্লাস নেওয়া দুষ্কর। সেজন্যই নেওয়া হচ্ছে না পরীক্ষা।

পরীক্ষার চেয়ে প্রাণ বাঁচানোকে গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া এই সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা খুশি, শিক্ষকরাও অসন্তষ্ট নন।

তবে শিক্ষার্থীদের যে পড়াশোনা এগোয়নি, তা নিয়ে অনেক অভিভাবক ভাবনায় রয়েছেন। ফলে যে পদ্ধতিতে এখন মূল্যায়ন হবে, তা ঠিকমতো হবে কি না, টিউশন ফির চাপ আসবে কিনা, তা নিয়ে তাদের এই ভাবনা।

‘সিদ্ধান্ত যথার্থ’

ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মিনহাজ তালুকদার মনে করেন, গ্রাম-শহর সব জায়গার শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে বার্ষিক পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ‘যথার্থ’।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনলাইনে আমরা পরীক্ষা দিতে পারলেও গ্রামে যারা আছে, তারা তো পারবে না। আর এতে মূল্যায়নটাও সঠিক হবে না। তাই এই সিদ্ধান্তটাই ঠিক মনে হচ্ছে।”

মিনহাজের মা শাহনাজ পারভীন বলছেন, “এই মহামারীতে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। মহামারীতে বেঁচে থাকলে তারপরের চিন্তাভাবনা। সামনে তো শীতের মৌসুম। ঠাণ্ডায় এর (করোনাভাইরাস) প্রকোপটা বেড়ে যায়। সেসব দিক চিন্তা করে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” 

বার্ষিক পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের মালিবাগ শাখার ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী তামিমের বাবা মিল্টন ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। কারণ বিকল্প যে পদ্ধতিতেই পরীক্ষা হোক, তাতে যথাযথ মূল্যায়ন হবে না। অনেকে অনৈতিক সুযোগ নেবে। আর স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা হওয়া মানে বিপদ ডেকে আনা।

“যেহেতু শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নটা হবে না তাই অনেকেই এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হবে না। তারপরও এটা মেনে নিতে হবে, কেননা এই সিদ্ধান্তটায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই লাভবান হবেন। কারণ পরীক্ষা নয়, জীবন আগে।”

রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের বনশ্রী শাখায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে নাহিয়ান আরাফ আয়ান।

নাহিয়ানের মা নাসরিন পারভিন বলেন, “দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করলে এই সিদ্ধান্তটা খুবই সময়োপযোগী হয়েছে। মহামারীতে ঝরে পড়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এটা রোধেও এটি কাজ করবে।

“এতদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, তারপর পরীক্ষা দিয়ে ফলাফল খারাপ হলে অনেকেই হতাশ হয়ে যেত, পড়াশুনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলত। আমার মনে হয়, খুবই ভালো হয়েছে।"

স্বস্তি প্রকাশ করে রাজধানীর বাড্ডা আলাতুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাঈশা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি খুবই খুশি হয়েছি। টেনশন কমেছে, খুব চিন্তায় ছিলাম কারণ এতদিন বাসায় থেকে কিছুই পড়া হয়নি। পরীক্ষা নিলে একদমই ভালো রেজাল্ট হত না।”

মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনতারা রাইসা বলেন, “এক্সাম হবে না, এটা একটা গুড নিউজ। এই প্যানডেমিকে এক্সাম নিয়ে এক্সট্রা প্রেশার ছিল।

“অনলাইনে ক্লাস করে তো আর ওভাবে প্রিপারেশন নেওয়া যায়নি। আর এই পরিস্থিতি কীভাবেই বা পরীক্ষা নেবে। সব মিলিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণাটা দিলেন, এতে আমাদের উপর থেকে একটা বিশাল চাপ কমল।”

অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি প্রাইভেট পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে ওঠা রাজধানীর উদয়ন স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহির আশহাব বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ার সিদ্ধান্তে ভীষণ খুশি।

“পরীক্ষা নিয়ে একটা টেনশন ছিল। অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি বাসায় প্রাইভেট পড়তে পড়তে একপ্রকার বিরক্তিকর পরিস্থিতিতেই ছিলাম। এখন শুনছি পরীক্ষা হবে না, শুনে ভালোই লাগছে।”

এই শিক্ষার্থীর বাবা রেজাউল করিম বলেন, “যেখানে পিএসসি, জেএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হচ্ছে না, সেখানে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার কোনো মানে হয় না।”

চাঁদপুর জেলার মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানহা তাবাসসুম বলেন, “এ বছরের মার্চ থেকেই স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না, অনলাইনে ক্লাস করছি। অনেক সমস্যা হচ্ছে। এর মধ্যে হুট করে বার্ষিক পরীক্ষা হলে সেটা আমাদের জন্য মোটেও ভালো হতো না। বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে না, ভালোই হল।”

তানহা তাবাসসুমের মা লায়লা আফরোজা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, “বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ার সিদ্ধান্তটি ঠিক আছে।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বন্ধ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যেই সম্প্রতি স্কুল ফিডিং প্রকল্পের বিস্কুট নিতে ঢাকার গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে খেলায় মেতেছিল ক্ষুদে এই শিক্ষার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মাধ্যমিক স্তরে বার্ষিক পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সময়ে এর কোনো বিকল্প নাই।”

ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া রেজওয়ান সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখন নেই। এই সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প ছিল না।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার্থীরা বহুদিন ধরে পড়াশুনার বাইরে ছিল, বইয়ের বাইরে ছিল, আবার অনেক অঞ্চলে বন্যাও হয়েছে। অনেক পরিবারের আয়-উপার্জন কমে গেছে।

“তাদের জন্য যদি এখন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, সেটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আমার মনে হয়, পরীক্ষার কোন বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, মহামারীতে তো আর কিছু করারও নাই।”

সংশয়

নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিদিকা আক্তারের মা লিপি আক্তারের মতে, পরীক্ষাটা নেওয়া দরকার ছিল।

কেন- সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “পরীক্ষা না হওয়াতে একটা ঘাটতি নিয়েই বাচ্চারা উপরের ক্লাসে উঠতেছে। এ ঘাটতিটা তাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। পরীক্ষা ছাড়া তো সঠিক মূল্যায়নটা হয় না।

“পরীক্ষা নেওয়া যেত। যেহেতু স্কুলেই পরীক্ষা হয়, সে হিসাবে অসুবিধা হওয়ার কথা না।”

ঢাকার মিরপুরের ঢাকা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী তামান্না হাবিবের মা হুমায়রা ইসলাম মনে করেন, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নটা জরুরি ছিল।

“আমার মেয়ে গত বছর ৭০ রোল থেকে ৬ হয়েছিল। ওর এবারের মূল্যায়নটা জরুরি ছিল। কিন্তু এবার তো স্কুল বন্ধ থাকায় কিছুই হল না, বিশাল গ্যাপ পড়ে গেল।”

অনলাইন ক্লাস নিয়ে তিনি বলেন, “তিন মাস আগে পরীক্ষা হয়েছিল, সেই খাতাটা শিক্ষকরা এখনও পর্যন্ত দেখেনি। কিন্তু টিউশন ফি দেওয়ার কথা বলেই যাচ্ছেন।”

অভিভাবকরা এই পরিস্থিতিতে টিউশন ফি কমানোরও দাবি তুলেছেন।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, “অ্যাসেসমেন্টের নামে যেন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জিম্মি করতে না পারে, টিউশন ফি আদায় করতে যেন চাপ দিতে না পারে।”

শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানান, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণের জন্য ৩০ কর্মদিবসে শেষ করা যায় এমন একটি সিলেবাস এনসিটিবি প্রণয়ন করেছে। ওই সিলেবাসের আলোকে শিক্ষার্থীদের প্রতি সপ্তাহে একটি করে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে।

সেই অ্যাসাইনমেন্টের মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীদের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী ক্লাসে তা পূরণের চেষ্টা করা হবে।

এ বিষয়ে দুলু বলেন, “অ্যাসেসমেন্টের যে বিষয়টি বলা হয়েছে, সেটার কারণে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে। এখন অভিভাবকই চাকরি হারিয়ে অভাব-অনটনে আছেন। তারপরও বেতন আদায়ের জন্য তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ দিকটাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং করতে হবে।”

ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া বলেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হলেও পরবর্তীতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি তো মানুষের মৃত্যু।

মাধ্যমিক স্তরে বার্ষিক পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে মনে করছেন সরকারি ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া।

তিনি বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা ছাড়া তো কোনো বিকল্প ছিল না। এটাকে মন্দের ভালো বলা চলে।

স্কুল ও অভিভাবকরা সচেতন হলে সহজেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

“আমরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছি সবসময়। অভিভাবকদের তার সন্তানের পড়াশুনার ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে, তারা যেন পড়াশুনার মধ্যে থাকে- সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।”

[প্রতিবেদনটি যৌথভাবে তৈরি করেছেন কাজী নাফিয়া রহমান, মেহেরুন নাহার মেঘলা, সাবিকুন্নাহার লিপি ও রাসেল সরকার]