ঢাবি শিক্ষক সামিয়া-মারজানের চৌর্যবৃত্তি ‘প্রমাণিত’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের বেশ কয়েকটি গবেষণা নিবন্ধে চৌর্যবৃত্তির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Sept 2020, 02:18 PM
Updated : 10 Sept 2020, 03:08 PM

তাদের বিষয়ে একাডেমিক অপরাধের শাস্তি সুপারিশ করতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তদন্ত কমিটি ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে মর্মে সিন্ডিকেটের সভায় রিপোর্ট পেশ হয়েছে।

“সভায় ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু কাদের নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে, এটা নির্ধারণ হয়নি। এটা নির্ধারণ করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।”

এবিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়ম-নীতি অনুযায়ীই সব কিছু হবে।”

সামিয়া রহমান ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সামিয়া রহমান ও মাহফুজুল হক মারজানের যৌথভাবে লেখা ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার : এ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ নামক আট পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’ নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়।

তবে তা ১৯৮২ সালের শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’তে প্রকাশিত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি নিবন্ধ থেকে প্রায় পাঁচ পৃষ্ঠা হুবহু নকল বলে অভিযোগ ওঠে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এক লিখিত অভিযোগে মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এই চুরির কথা জানিয়েছিল ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস।

শুধু মিশেল ফুকোই নন, বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম' গ্রন্থের পাতার পর পাতাও সামিয়া ও মারজান হুবহু নকল করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমেদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট।

দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে গত বছর ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির সুপারিশ করা হয়নি।

পরে বিষয়টি নিয়ে আইনি সুপারিশ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ এফ এম মেজবাহউদ্দিনকে দায়িত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।

প্রায় তিন বছর পর বুধবার সিন্ডিকেটের সভায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট উত্থাপন করা হয়।

এবিষয়ে অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্লেইজারিজমের যে অভিযোগ ছিল, আমাদের তদন্তে দ্যাট হ্যাজ বিন প্রোভেন (তা প্রমাণিত হয়েছে)। আমাদের তদন্তে তাদের যৌথভাবে লেখা ছয়টি গবেষণা নিবন্ধনে প্যারার পর প্যারা হুবহু নকল পাওয়া গেছে।”

সামিয়া রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার পাশাপাশি টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ এবং অনুষ্ঠান উপস্থাপিকা হিসেবে কাজ করেন। অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহফুজুল হক মারজান এক সময় সামিয়া রহমানের ছাত্র ছিলেন।

তাদের নিয়ে তদন্ত করতে নানা ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হয়েছে তদন্ত কমিটিকে।

নাসরীন আহমাদ বলেন, “আমাদের কলিগদের বিষয়ে যখন কোনো অভিযোগ ওঠে, আমরা চেষ্টা করি খুব কেয়ারফুলি দেখতে, যাতে তাদের উপর কোনো অন্যায় না হয়।

“কিন্তু তাদের ব্যাপারে আমরা যখন ইনকোয়ারি শুরু করি, চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। অনেক হৈ চৈ শুরু হয়। যাই হোক, আমরা আমাদের মতো কাজ করেছি।”

নিজের অসুস্থতার কারণে তদন্তে একটু সময় বেশি লেগেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা তো অনেক আগেই রিপোর্ট জমা দিয়েছি। দেরিতে কেন বিষয়টা সিন্ডিকেটে উঠল? সেটা দেখে অবাক হলাম।”

এ প্রসঙ্গে সাবেক উপ-উপাচার্য নাসরিন আহমাদ বলেন, গবেষণাকাজে চৌর্যবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়া উচিৎ।

“প্লেইজারিজমের জন্য যে শাস্তি, তা হবে ঠিক আছে। কিন্তু এই যে বার বার প্লেইজারিজম হচ্ছে, তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর হওয়া উচিৎ। আমরা এটাও নোটিস করেছি, ইদানিং প্লেইজারিজম বেশি বেশি হচ্ছে। কীভাবে আমরা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করব, তার একটা সুস্পষ্ট আইন থাকা দরকার।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। কিন্তু সেখানে চৌর্যবৃত্তির শাস্তি নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়ই চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ঘটছে।

তদন্ত কমিটি চৌর্যবৃত্তি নিয়ে নীতিমালা তৈরি করতেও সুপারিশ করেছে বলে জানান তদন্ত কমিটির সদস্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৭৩ এর অর্ডারে প্লেইজারিজম বলতে তো কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষকদের কেউ অনৈতিক কাজ করলে, তা নিয়ে আইন রয়েছে।

“প্লেইজারিজম অনৈতিক কাজের মধ্যেই পড়ে। আমরা তদন্ত প্রতিবেদনে এটাও সুপারিশ করেছি, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্লেইজারিজম নিয়ে নীতিমালা তৈরি করে।”