করোনাভাইরাসের রূপ বদলের হার বাংলাদেশে ‘অনেক বেশি’

বিশ্বজুড়ে পৌনে নয় লাখ মানুষের মৃত্য ঘটানো নতুন করোনাভাইরাস বাংলাদেশে ‘খুব দ্রুত’ নিজেকে বদলে ফেলছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2020, 03:06 PM
Updated : 6 Sept 2020, 03:20 PM

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবের বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বে করোনাভাইরাসের নমুনাপ্রতি মিউটেশনের হার যেখানে ৭ দশমিক ২৩, সেখানে বাংলাদেশে সেই হার ১২ দশমিক ৬০।

করোনাভাইরাসের জিনগত বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য ২৬৩টি নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্স ও ডেটা বিশ্লেষণ শেষে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরেছেন তারা।

জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবের প্রধান সেলিম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাইরাসের রূপ পরিবর্তনের হার প্রায় দ্বিগুণ বলে একে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বেশি ভীতিকর- এমনটা বলা যাবে না। ভাইরাস নিয়মিত রূপ পরিবর্তন করে। সেটা কতটা ভীতিকর হবে, তার জন্য আমাদের আরও অনেক গবেষণা করতে হবে।”

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান আলী আফতাব শেখও উপস্থিত ছিলেন এই সংবাদ সম্মেলনে।

গত বছরের শেষ দিকে চীন থেকে ছড়াতে শুরু করে পুরো বিশ্ব দখল করে নেওয়া নতুন করোনাভাইরাসের নাম দেওয়া হয়েছে সার্স সিওভি-২। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সোয়া তিন লাখ মানুষের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের।

মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আগে এই ভাইরাসের চরিত্র ভালোভাবে বুঝতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের বিজ্ঞনীরাও সেই চেষ্টায় এর জিনবিন্যাস বিশ্লেষণ করে মিউটেশন বা রূপবদলের ধরনটি বোঝার চেষ্টা করছেন।

লিখিত বক্তব্যে আলী আফতাব শেখ বলেন, “২৬৩টি সার্স-কোভ-২ জিনোম বিশ্লেষণ করে জানা যায়, সর্বমোট ৭৩৭টি পয়েন্টে মিউটেশন হয়েছে, যার মধ্যে ৩৫৮টি নন-সিনোনিমাস অ্যামাইনো এসিড প্রতিস্থাপন ঘটেছে। এখন পর্যন্ত সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের মিউটেশনের বার্ষিক হার ২৪ দশমিক ৬৪ নিউক্লিওটাইড।”

করোনাভাইরাসের জিন কাঠামোতে ১ হাজার ২৭৪টি প্রোটিন থাকে, যার মধ্যে ২১২ থেকে ৫২৩ নম্বর প্রেটিন হল গুরুত্বপূর্ণ স্পাইক প্রোটিন।

স্পাইক প্রোটিন হল ভাইরাসটির বাইরের একটি কাঠামো, যা এটি মানব কোষে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করে।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যেসব নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাতে ওইসব প্রোটিনে কোনো মিউটেশন দেখা যায়নি বলে জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবের বিজ্ঞানীরা গত জুলাই মাসে জানিয়েছিলেন।

তবে করোনাভাইরাসের যেসব বদলে যাওয়া রূপ বা স্ট্রেইন বিজ্ঞানীদের বেশি ভাবাচ্ছে, তার মধ্যে একটি হল ডি৬১৪জি।

এই মিউটেশনে ৬১৪ নম্বর প্রোটিন (অ্যামাইনো অ্যাসিড) ডি বা অ্যাসপারাটিক অ্যাসিড থেকে বদলে জি বা গ্লাইসিন হয়ে যায়। তাতে ভাইরাসটি আরও অনেক বেশি স্পাইক পায়। ফলে মানবকোষে ঢোকা আরও সহজ হয়।

পুরো বিশ্বেই করোনাভাইরাসের এই স্ট্রেইনটি অনেক বেশি সক্রিয় এবং বাংলাদেশেও তা দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

বিসিএসআইআর এর সংবাদ সম্মেলন

রোববারের সংবাদ সম্মেলনে আলী আফতাব শেখ জানান, বাংলাদেশে ২৬৩টি সার্স-কোভ-২ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পর শতভাগ ক্ষেত্রে তারা ‘ডি৬১৪জি’ করোনাভাইরাস স্ট্রেইনটি পেয়েছেন।

“বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সর্বমোট ৭৩৭টি পয়েন্টে এর মিউটেশন হয়েছে, যার মধ্যে ৩৫৮ নন-সিনোনিমাস অ্যামিনো এসিড প্রতিস্থাপন ঘটেছে।”

এর মধ্যে ৬১৪ নম্বর অ্যামাইনো অ্যাসিড বদলে গ্লাইসিন হয়ে যাওয়ার কারণেই বাংলাদেশে সংক্রমণের মাত্রা বাড়ছে বলে জানান সেলিম খান।

এই জিনবিজ্ঞানী নিজেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং সম্প্রতি সেরেও উঠেছেন।

টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস হল আরএনএ ভাইরাস। আমরা দেখেছি, এর নিউক্লিওটাইডে পরিবর্তন এসেছে ৭৩৭টা। নিওক্লিওটাইডের পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তন হয় অ্যামাইনো এসিডের। দেখা গেছে, পরিবর্তন ৭৩৭টি অ্যামাইনো এসিডে আসেনি, এসেছে ৩৩৮টায়। “

গবেষণার সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরে সেলিম খান বলেন, “স্পাইক প্রোটিনের জিনে ১০৩টি নিউক্লিওটাইড মিউটেশনের মধ্যে ৫৩টি নন-সিনোনিমাস অ্যামিনো এসিড প্রতিস্থাপন ঘটেছে, যার মধ্যে ৫টি স্বতন্ত্র; যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায়নি।”

সংগৃহীত নমুনাগুলোর মধ্যে চারটি মিউটেশনে পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা গেছে। এগুলো হল ‘২৪১ সাইসোটিন>থায়ামিন’, ‘৩০৩৭ সাইটোসিন>থায়ামিন’, ‘১৪৪০৮ সাইটোসিন>থায়ামিন’, ‘২৩৪০৩ অ্যাডিনিন>গুয়ানিন’।

জিনোম বিশ্লেষণ শেষে বাংলাদেশে সার্স-কোভ-২ এর পাঁচটি স্ট্রেইন দেখতে পেয়েছেন বলে জানান সেলিম খান।

তিনি বলেন, “আমরা ২৪৩টি জিআর ক্লেড, ১৬টি জিএইচ ক্লেড, ৩টি জি ক্লেড, একটি ও ক্লেডের অন্তুর্ভুক্ত করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পেয়েছি।”

আলী আফতাব শেখ জানান, তাদের এই গবেষণার ফলাফল ইতোমধ্যে চীনের সিনোভ্যাক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, যুক্তরাস্ট্রের মডার্না ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের ৫০টি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে। 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, “ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ, টিকা বা ভ্যাকসিন তৈরির জন্য। কিন্তু টিকা বা ভ্যাকসিন এসে গেলেও আমরা এই সিকোয়েন্সিং বন্ধ করব না। আমরা এটা চালিয়ে যাব। কারণ জিনোম সিকোয়েন্স করে আমরা আরও নতুন নতুন রোগের সন্ধানও পেতে পারি।”