পরিবহন শ্রমিকদের কষ্টের ঈদ

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে গণপরিবহন বন্ধ দুই মাস ধরে। ফলে দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল পরিবহন শ্রমিকদের জমানো টাকাও ফুরিয়ে যাওয়ায় ঈদের সময় পড়েছেন চরম আর্থিক সঙ্কটে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2020, 06:40 PM
Updated : 24 May 2020, 06:40 PM

এই দুঃসময়ে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের পাশে না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন শ্রমিকরা। তারা বলছেন, নেতারা তাদের নানা কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি চাঁদা নিয়মিত নিলেও সঙ্কটকালে তাদের কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কয়েকজন পরিবহন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললে তাদের বেশিরভাগই জানান, এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা পাননি তারা।

সৌদিয়া পরিবহনের চালক সাইফুল ইসলাম থাকেন রাজধানীর গাবতলীর বাগবাড়ি এলাকায়। লকডাউনের পর থেকে কাজ বন্ধ তার।

কোনো সহায়তা না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আইজ প্রায় দুই মাস ধইরা কাজ বন্ধ। পকেটে একটা টাকা নাই। আমরা এই বিপদে আছি কেউ চাইর আনা পয়সা দিয়া সাহায্য করে নাই।

“এমন পরিস্থিতি… সেমাই যে কিনুম সেই পয়সাটাও নাই। কী যে অবস্থায় আছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।”

মৌলভীবাজারে পরিবহন শ্রমিকরা ঈদের আগের দিন বিক্ষোভে নামে

গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকার লিটন সদরঘাট-গাজীপুর চৌরাস্তা রুটের স্কাইলাইন পরিবহনের সুপারভাইজার।

ঈদ কেমন কাটছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিকেলে গাড়ির মালিক ডেকে নিয়ে এক হাজার টাকা দিয়েছেন তাকে। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই প্রথম কেউ তাকে আর্থিক সাহায্য করলো। এতদিন তার বাবা-ভাই, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে চলছেন।

কথা বলার এক পর্যায়ে ধরা গলায় লিটন বলেন, “খুব অসহায় লাগতেছে। ছেলেডা খুব ছোট, তারে একটা জামা কিন্না দিতে পারি নাই। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, বিপদের দিনে শ্রমিক নেতারা পাশে নাই। এই ঈদ আমাদের জন্য খুবই কষ্টের ঈদ।”

শনিবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নারায়ণগঞ্জের পুরিন্দা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের পাশে দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটের কয়েকটি বাস রাখা। পাশেই বসেছিলেন কয়েকজন পরিবহন শ্রমিক।

এদের একজন ঢাকা-ভৈরব রুটের বাসচালক সোহাগ বলেন, গাড়ি চলাচল বন্ধ হওয়ার পর মালিকরা কোনো যোগাযোগ করেননি। কোনো ধরনের সহায়তাও পাননি।

তিনি বলেন, লকডাউন শুরুর পর সম্প্রতি একজন শ্রমিক নেতা তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি নিয়েছেন। তবে এখনও কোনো সহায়তা পাননি।

“ফটোকপি নিছে। কিন্তু নেওয়ার সময় কইছে যদি কোনো সহায়তা না করতারে তাইলে হেগোরে য্যান দোষারোপ না করি। এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাই নাই।”

বাবুল মিয়া নামে আরেকজন চালক বলেন, শুক্রবার স্থানীয় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চাল-ডালসহ কিছু খাদ্যসামগ্রী সহায়তা হিসেবে দিয়েছেন।

“এইডা ছাড়া আর কোনো সহায়তা বাস শ্রমিকরা পায় নাই।”

লালমনিরহাটেও বিক্ষোভ করেছিল পরিবহন শ্রমিকরা

এখানেই কথা হয় বাসমালিক মিলন মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপদে পড়েছেন তিনিও। তার গাড়িগুলো যে পরিবহন কোম্পানির অধীনে চলে। সে কোম্পানি মার্চ মাসের বিলও দেয়নি।

“আমার গাড়ি যে চলছে সেই টাকা কোম্পানির কাছে পামু। তাদের কোনো খবর নাই। ফোন দিলে ধরে না, খালি লকডাউন দেখায়। তারা এসে বইসা আছে, আমি তাদের কীভাবে হেল্প করমু কন?”

শ্রমিকদের নামে তোলা অর্থ শ্রমিকদের জন্য খরচ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ জাতীয় সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়োগপত্র থাকলে শ্রমিকরা বেতনের অর্ধেক পেত। কিন্তু পাচ্ছে না।

“শ্রমিকদের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া হচ্ছে তাও ভালো কোনো কাজে ব্যবহার হচ্ছে না। ওই টাকা কোথায় গেল? এই টাকা শ্রমিকদের দিলে তাদের না খেয়ে থাকতে হতো না।”

সম্প্রতি ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর সেকশনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় পরিবহন শ্রমিকরা (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, তারা শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে সংগঠনের গচ্ছিত অর্থ থেকে শ্রমিকদের সহায়তা করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পুরোপুরি সহায়তা করা সম্ভব না। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের নানা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় এ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু জেলায় এখনও সে কাজটি বাকি আছে।

সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, “আমরা জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। তাদের মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। শুধু পরিবহন শ্রমিক না, সারাদেশের সব শ্রমিকদের জন্যই এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।”

শ্রমিকদের তহবিল থেকে সহায়তা ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি নিশ্চিত হতে তিনি শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে একটা চিঠি দিয়েছেন।

“আমি জানতে চেয়েছি কে, কীভাবে কত টাকা দিলেন। মালিকদের কাছ থেকে কত টাকা পেলেন। সেই টাকা কীভাবে খরচ করলেন। ত্রাণ যে বন্টন করেছেন সেই ছবিসহ আমাদের কাছে পাঠাতে বলেছি। এগুলো পেলে বলা যাবে কতজনকে কীভাবে সহায়তা করা হয়েছে।”