বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত (৮ মার্চ) হওয়ার আড়াই মাসের মধ্যে এখন নমুনা পরীক্ষার আওতা ঢাকাও ঢাকার বাইরে অনেকটাই বিস্তৃত হয়েছে। আর দুরূহ এই কাজটি সহজ হয়েছে নমুনা পরীক্ষার গবেষণাগার চালুর নেপথ্যে থাকা একদল গবেষকের নিরলস চেষ্টায়, যারা মূলত পরিচিত ‘বায়োলিজস্ট’ হিসেবে। পুরোপুরি স্বেচ্ছায় তারা যুক্ত হয়েছেন অভাবনীয় এ যুদ্ধে।
গবেষক থেকে স্বেচ্ছাসেবক বনে যাওয়া এই দলের সদস্যরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণাগার চালুতে যেমন দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের নানা প্রান্তে, তেমনি কোনো সচল গবেষণাগারে পরীক্ষা ব্যাহত হলে সেখানেও ছুটে যাচ্ছেন। নতুন এই ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ, কিটের ব্যবহার, পরীক্ষার ফলাফল সংগ্রহ- সবকিছুই তারা হাতে-কলমে শিখিয়ে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের।
সারাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর এই রোগ নির্ণয়ের জন্য গবেষণাগার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এজন্য দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার কিট আরটি-পিসিআর বসানো হচ্ছে। এই কিট সরবরাহ এবং স্থাপনের কাজটি করছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
এএসএম শামীমের দেওয়া তথ্য মতে, ঢাকা, ফরিদপুর, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, মুগদা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমির্টোলা জেনারেল হাসপাতাল, আর্মড ফোর্সেস ই্নস্টিটিউট অব প্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউব অব মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের আরটি-পিসিআর চালু করতে কাজ করেছেন বায়োলজিস্টরা।
তারা এখন কাজ করছেন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতাল এবং সিরাজগঞ্জ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে।
কিভাবে তারা এই কাজ করছেন জানতে চাইলে এএসএম শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আরটিপিসিআর মেশিন বসানো হয় হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে। স্থাপনের পর চিকিৎসক, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষার কাজটি হয়।
“নতুন হওয়ার কারণে নভেল করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা কিছুটা জটিল। যারা সার্বক্ষণিক গবেষণাগারে কাজ করেন না তাদের জন্য তাই কাজটি করা কঠিন। এখানেই প্রয়োজন হয় প্রশিক্ষিত লোকের।
দেশের ক্রান্তিলগ্নে নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর ইচ্ছা থাকলেও শুরুর পথ ততটা মসৃন ছিল না বলে জানান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাবিবুল বারী সজীব। নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেও খুব একটা সাড়া পাননি। পরে এক সহকর্মীর মাধ্যমে আরটি-পিসিআর মেশিন সরবরাহকারী ওভারসিজ মার্কেটিং কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা।
হাবিবুল বারী বলেন, “আমরা যেহেতু মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট, সেসব ল্যাবে বায়োসেইফটি, বায়োসিকিউরিটি এসব নিশ্চিত করতে সেখানকার চিকিৎসক এবং টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করলাম।
“দেশের এই প্রয়োজনে যুক্ত হতে চেয়েছি। আমরা সবসময় চেয়েছি তাদের কিভাবে সহায়তা করা যায়। রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে এখানে অবদান রাখা আমাদের জন্য সহজ। আর এখন অফিস বন্ধ, তাই পুরো সময় এখানে দিতে পারছি।”
বায়োকেমিস্টদের সঙ্গে আরটি-পিসিআর মেশিন সরবরাহকারী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে যোগসূত্রের কাজটি করেছেন সুমন চন্দ্র বৈদ্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী বর্তমানে কাজ করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
“প্রস্তাব দিই এই প্রক্রিয়ায় আমরা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে চাই। তারা আমাদের হেল্প করেছে। যেসব জায়গায় ল্যাব হচ্ছে সেখানে যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তারা করে দিচ্ছে।”
বায়োলজিস্টদের সহায়তা না পেলে গবেষণাগার চালু সম্ভব হত না বলে জানান ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম।
“আমাদের টেকনোলজিস্টরা হয়তো মেশিনটা চালাতে পারবেন। কিন্তু প্রতিটা অর্গানিজমের জন্য প্রোগ্রামটা ভিন্ন। সুতরাং নতুন কেউ এই মেশিন চালাতে গেলে তাকে বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত করতেই হবে। বায়োলজিস্টরা বিষয়টি দেখিয়ে না দিলে আমরা পরীক্ষাটি চালু করতে পারতাম না। এটা সম্ভব ছিল না। নিঃসন্দেহে তারা আমাদের অনেক হেল্প করেছেন।”
গবেষকদের এই সহায়তার প্রশংসা করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানাও।
“চিকিৎসা খাতের লোকেরা আরটি-পিসিআরে সবাই তেমন অভ্যস্ত না। এছাড়া এই ভাইরাসটাও নতুন। নন-মেডিকেল মলিক্যুলার বায়োলজিস্টরা আগে থেকেই এই মেশিনে আরএনএ, ডিএনএ নিয়ে কাজ করে অভ্যস্ত। উনারা আমাদের কর্মীদের সেভাবেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। মেশিনগুলো চালাতে সাহায্য করছেন। তারা এগিয়ে আসায় আমাদের কাজটি সহজ হয়েছে।”