কোভিড-১৯: মেডিকেল টেকনোলজিস্ট স্বল্পতায় নমুনা পরীক্ষায় হিমশিম

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় নমুনা পরীক্ষার উপর জোর দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা; একই কথা বিশেষজ্ঞদেরও। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটিতে যাদের ভূমিকা থাকে, সেই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকায় নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষায় হিমশিম অবস্থা বাংলাদেশে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2020, 05:55 AM
Updated : 30 April 2020, 06:45 AM

এই সঙ্কট মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চাহিদাপত্র পেয়ে এরই মধ্যে দুই হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ হাজারের বেশি নার্স নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসি। কিন্তুও সেই চাহিদাপত্রেও নেই মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের কথা। 

কিন্তু প্রয়োজনীয় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ছাড়া করোনাভাইরাস মোকাবেলার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, অর্থাৎ নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্তদের শনাক্তের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যই অর্জন করা যাবে না বলে মনে করেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন।

“সরকার চিকিৎসক-নার্সের সংখ্যা বাড়াচ্ছে ভালো কথা। কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজিস্টও নিয়োগ দিতে হবে। আমরা টেস্টের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছি, কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ছাড়া স্যাম্পল কালেকশন কে করবে? এটা তো অপেশাদার লোকদের কাজ না।”

অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে নিয়োজিত থাকা টেকনোলজিস্টরা বলছেন, লোকবল স্বল্পতায় তাদের একেকজনের ঘাড়ে অনেক কাজ জমছে।

বাংলাদেশ এখনও কোভিড-১৯ রোগের নমুনা পরীক্ষায় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে পিছিয়ে আছে।

ছবি: নয়ন কর

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স এবং পাঁচজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি ভিন্ন।

গত ২১ মার্চের হিসাব অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে বর্তমানে ২৫ হাজার ৬১৫ জন চিকিৎসক কাজ করছেন। ডব্লিউএইচওর মানদণ্ড অনুযায়ী, এক্ষেত্রে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদের সংখ্যা হওয়ার কথা ছিল এক লাখ ২৮ হাজার ৭৫টি।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদই আছে সাত হাজার ৯২০টি। এর বিপরীতে কর্মরত আছেন আরও কম পাঁচ হাজার ১৮৪ জন। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ৩২ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কাজ করছেন।

আর ল্যাব টেকনোলজিস্টের দুই হাজার ১৮২টি পদের মধ্যে এক হাজার ৪১৭ জন কর্মরত আছেন। নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটি করেন ল্যাব টেকনোলজিস্টরাই।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন জেলা থেকে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রেষণে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আনা হয়। ফলে জেলাগুলোয় নমুনা সংগ্রহ করতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

বিভিন্ন জেলা এমনকি নারায়ণগঞ্জেও অনেকে অভিযোগ করেছেন, নমুনা সংগ্রহের জন্য হটলাইনে ফোনের পর ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায় না।

ছবি: নয়ন কর

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের পর সবচেয়ে আক্রান্তের এলাকা গাজীপুরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আছেন ১৭ জন। এর মধ্যে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে চারজন এবং হাসপাতালে সাতজন। প্রত্যেকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন করে এবং টঙ্গীতে ২৫০ শয্যা হাসপাতালে একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোটামুটি কাজ চললেও ঝামেলায় আছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মীরা।

একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন টেকনোলজিস্ট জানান, তাকে দৈনিক ২৫ থেকে ৩৫টি নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। এজন্য দুজন সহযোগী নিয়েছেন তিনি। তারা রোগীর নাম ঠিকানা লিখে দেওয়া থেকে প্রাথমিক কিছু কাজ করে দেয়।

“নমুনা সংগ্রহের কাজটা আমি করি। কিন্তু প্রতিদিন এতগুলো নমুনা সংগ্রহ করতে জান বাইর হয়ে যায়। গাজীপুর জেলায় তো অনেক রোগী, সবার স্যাম্পল নেওয়া সম্ভব হয় না।”

নরসিংদীর পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিলীপ কুমার দাস জানান, উপজেলায় কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। ফলে কন্টাক্ট ট্রেসিংসহ নানা কাজে তাকে নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। এখানে দুজন মেডিকেল টেকনোলজিস্টের একজনকে ঢাকার একটি হাসপাতালে প্রেষণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

“আমিই বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করি। আবার আমাকেই দৌড়াতে হয় হাসপাতালে। বিষয়টি নিয়ে আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।”

একই অবস্থা নরসিংদীর বাকী উপজেলাগুলোতেও।

স্বাধীনতা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব মুহম্মদ মাহবুব হাসান নতুন চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগকে স্বাগত জানালেও মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা উপেক্ষিত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, “ডব্লিউএইচওর গাইডলাইন অনুযায়ী ২ হাজার চিকিৎসকের বিপরীতে ১০ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হল তারা আলোচনাতেই নেই।”

বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে দেশে ৩০ হাজার ৬৭ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রয়েছেন।

সংগঠনের সভাপতি আলমাস আলী খান জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা ঝুঁকি নিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করছেন। কয়েকটি হাসপাতালে সংক্রমণের পর চিকিৎসক-নার্সরা কোয়ারেন্টিনে গেলেও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পাঠানো হচ্ছে না।

“কারণ টেকনোলজিস্টরা কোয়ারেন্টিনে গেলে সেখানে কাজ করার কেউ থাকে না।”

তিনি বলেন, সাময়িকভাবে কিছু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিলেও এই পরিস্থিতিতে কাজ করা কিছুটা সহজ হবে।

“এখন যদি হাজার বিশেক টেকনোলজিস্টও নেওয়া যায় তাহলেও এই মহামারী কিছুটা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। সেটা অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও। আমাদের এই মুহূর্তে একটাই দাবি।”

অবশ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় ১২০০ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের জন্যও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. বেলাল হোসেন।

কিন্তু অচিরেই এই নিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান খান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকারের পে-রোলে কাউকে আনতে হলে সিস্টেমের মধ্যে আনতে হয়। টাকা পয়সারও ব্যাপার আছে। ওটা (টেকনোলজিস্ট নিয়োগ) এখনও চিন্তাভাবনার মধ্যে আছে। এখনও প্রসেস শুরু হয়নি।”

হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, বেকার, প্রশিক্ষণে থাকা মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের তালিকা তৈরি করছেন তারা। এছাড়া অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। নমুনা সংগ্রহ কাজে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।

“আমরা তাদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। অনেক জায়গায় চিকিৎসকরাও নমুনা সংগ্রহ করছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেককে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা কাজ চালানোর চেষ্টা করছি। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তারা শুধু নমুনা সংগ্রহ করছেন।”