পিআইবির বইয়ে শহীদ সাংবাদিকের তালিকায় নেই সিরাজুদ্দীন

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) থেকে প্রকাশিত ‘সংবাদপত্রে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বইটি ১৩ জন শহীদ সাংবাদিককে উৎসর্গ করা হলেও সেখানে সিরাজুদ্দীন হোসেন নেই, যার নাম মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিকদের স্মরণে প্রথম দিকেই উঠে আসে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2020, 04:49 PM
Updated : 13 May 2020, 05:41 PM

একাত্তরে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাম শহীদ সাংবাদিকদের তালিকায় না রাখাটা ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন বইটির সম্পাদক অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন। সংশোধন করে সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাম বইতে সংযুক্ত করার কথা বলেছেন তিনি।

আর নাম বাদ পড়ায় শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীনের পরিবারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ।

তবে এই শহীদ সাংবাদিকের পরিবারের পক্ষ থেকে বইয়ের সংশোধন ছাড়াও এ ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

একাত্তরের শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন

‘সংবাদপত্রে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ' শিরোনামের এই গবেষণাধর্মী বইটি পিআইবি থেকে প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। বইটি ১৩ জন শহীদ সাংবাদিককে উৎসর্গ করা হলেও সেখানে সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাম না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেইসবুকে পোস্ট দেন শহীদ সাংবাদিকের ছোট ছেলে তৌহীদ রেজা নূর।

তিনি বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুরো বিষয়টাই বিব্রতকর। এটা পিআইবির জন্যও বিব্রতকর। আমাদের জন্যও বিব্রতকর। জাতির জন্যও বিব্রতকর।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমানে কলা অনুষদের ডিন দেলোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিগগিরই শহীদ সাংবাদিকের (সিরাজুদ্দীন হোসেনের) নাম সংযোজন করার বিষয়ে পিআইবি মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাম উৎসর্গপত্রে বাদ পড়াটাকে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে দাবি করেন তিনি।

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী সিরাজুদ্দীন হোসেনকে শান্তিনগরের চামেলীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তখন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। 

পিআইবির ওয়েবসাইটে সিরাজুদ্দীন হোসেন সম্পর্কে লেখা হয়েছে, “তিনি কোনো দিন শাসক শ্রেণির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে তার যুক্ততা ছিল। কলম সচল ছিল প্রতিটি ক্ষেত্রেই। তিনি  ছিলেন আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। তাই অনেকের মতো তাকেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর ঘাতকের টার্গেটে পরিণত হতে হয়েছিল।”

১৮ বছর বয়সে ছাত্র অবস্থায়ই সাংবাদিকতায় জড়ানো সিরাজুদ্দীন হোসেন ৪২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনের ২৪ বছরই সাংবাদিকতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিকদের স্মরণ ও তালিকায় প্রথমেই আনা হয় তার নাম।

পিআইবি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে কীভাবে এই সাংবাদিকের নাম বাদ পড়ল, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত তৌহীদ রেজা নূর।

তিনি বলেন, “পিআইবির মতো প্রতিষ্ঠান সত্য তুলে ধরবে। সিরাজুদ্দীন হোসেন বাদ পড়েছে বলে আমি বলছি না। এই ধরনের গবেষণা করতে গেলে আগামীতেও যেন একই ভুল না হয় সেই জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা রক্ষা করতে হবে।”

তৌহীদ রেজা নূর বলেন, “এ ঘটনার একটা তদন্ত কিন্তু হওয়া দরকার আছে। যার নাম সবার প্রথমে থাকে সেই নামটা বাদ পড়ে যায় কেন? এই তদন্ত হওয়া ও ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার আছে।

“এত বড় ভুল কীভাবে হয় তা খতিয়ে দেখা জরুরি পিআইবির স্বার্থে। সঠিক ইতিহাস রক্ষার স্বার্থে। শহীদের সম্মান ও অবদান রক্ষার স্বার্থে।”

'সংবাদপত্রে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ' বইয়ের বিক্রি বন্ধ করে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে সংশোধন করে আবার প্রকাশ করারও দাবি জানান তৌহীদ রেজা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ত্রুটির জন্য সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পরিবারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। নাম বাদ পড়ল কেন বা ত্রুটি কেন হল তাও দেখব আমরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সেই সঙ্গে আরও কিছু গ্রন্থে এ ধরনের ত্রুটি খুঁজে বের করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

জাফর ওয়াজেদ বলেন, “এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে পারে। ত্রুটি হতে পারে। কোনোভাবে ইচ্ছাকৃত কিছু হয়েছে কি না তা খুঁজেও দেখা দরকার।”

সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘সংবাদপত্রে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ' গ্রন্থটি তৎকালীন মহাপরিচালক ও উপদেষ্টাদের চোখে কেন ধরা পড়েনি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৮ সালে শাহ আলমগীর পিআইবির মহাপরিচালক থাকার সময় গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশ হলেও কাজ শুরু হয়েছে আরও আগে। পিআইবির সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান মিলনের সময়কালে আরও কিছু গ্রন্থে শহীদ সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ত্রুটি ধরা পড়েছে পিআইবির কাছে।

বইটির সম্পাদক অধ্যাপক দেলোয়ার জানান, সম্পাদনার সব দায় দায়িত্ব তার। এ কাজে সহযোগিতার জন্য পিআইবির একজন গবেষকও (ড. কামরুল হক) যুক্ত ছিলেন।

“শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাম বাদ পড়ার বিষয়টি গতকাল একজন আমার নজরে এনেছেন। আমি পিআইবির ড. কামরুল হকের সঙ্গে কথা বলেছি। এটা বড় ধরনের ভুল। শহীদ সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার কোনো কারণও নেই।”

পিআইবি মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে লকডাউন শেষে উৎসর্গ তালিকায় নাম সংযোজন করা হবে বলে জানান দেলোয়ার হোসেন।

অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, “ভালো গবেষণার কাজ করেছি। ভালো বই করলাম, আর নামটা বাদ পড়বে তা হয় না। তৎকালীন পিআইবির ভুল বলব না, সামগ্রিক ভুল হয়েছে। এখন সংযোজন করা হবে। শহীদ সাংবাদিকের ছেলের (তৌহীদ রেজা নূর) সঙ্গে কথা বলব আমি। ডিজি মহোদয়ের সঙ্গেও কথা হবে। ওই পাতাটি নতুন করে সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। পিআইবি যখনই তা করতে চায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তৌহীদ রেজা নূর ফেইসবুকে লিখেছেন, “কিন্তু আমার পিতা তদানীন্তন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন-এর নাম কোথাও নেই। কেন নেই? একে কি বলব? অনিচ্ছাকৃত ভুল? ইচ্ছাকৃত ভুল? নাকি যারা জড়িত আছেন এই বইয়ের সাথে তাদের জানা নেই যে সিরাজুদ্দীন হোসেন নামে এই দেশে একজন সাংবাদিক ছিলেন - বাংগালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে যিনি দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় পাতায় আগুন ঝরিয়েছেন, নানা চক্র চক্রান্তের অন্তহীন প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর গণমানুষের রাজনীতিকে পত্রিকার পাতায় ধারণ করে সারা দেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন (অন্য আর সব অবদানের কথা আপাতত নাই বা লিখি এখানে) - যিনি একাত্তরের ডিসেম্বরে আলবদর বাহিনীর বুদ্ধিজীবী অপহরণ ও নিধনযজ্ঞের প্রথম শিকার।”

তৌহীদ রেজা নূর লিখেছেন, “কেন এই ভুল হয়েছে? আমি তার উত্তরাধিকার হিসেবে এই প্রশ্নের জবাব চাই পিআইবি'র কাছে।”