বৃহস্পতিবার স্বাধীনতা দিবসের ছুটির সাথে সাপ্তাহিক আর সাধারণ ছুটিতে সুনসান রাজধানী। বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আগে অনেকে ঢাকা ছাড়তে পারলেও যারা রাজধানীতে রয়েছে গেছেন তারা এখন ‘গৃহবন্দি’।
স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতিকে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনার করে সবাইকে ঘরে থেকে এই যুদ্ধ জয়ের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে যে চিত্র দেখা গেল, তেমনটা শান্তির সময়ে কখনও মানুষ দেখেনি।
রাজধানীর রাজপথ-অলিগলি এখন প্রায় জনশূন্য। মাঝেমধ্যে জরুরি প্রয়োজনে বের বের হওয়া কিছু যানবাহন আর রিকশার ঘণ্টার আওয়াজ কানে আসে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটা ছাড়া পারতপক্ষে মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে না।
মানুষের ‘অহেতুক’ রাস্তায় ঘোরাঘুরি বন্ধে তৎপর আইন শৃঙ্খলাবাহিনীও। অপ্রয়োজনে রাস্তায় বের হলেই পড়তে হচ্ছে পুলিশের সামনে; মৃদু পিটুনির খবরও পাওয়া গেছে।
এরপরও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। বন্ধ হয়েছে বিপণীবিতান, গণপরিবহন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে কাজ করছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও।
কভিড-১৯ এ ইতোমধ্যে বিশ্বে ২১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে মারা গেছেন পাঁচজন, আক্রান্তের সংখ্যা ৩৯।
তবে অত্যন্ত ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাগম এড়ানোর পরামর্শ বারবার দেওয়া হলেও ছুটির সকালে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ সংলগ্ন কাঁচা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে মানুষের মধ্যে একধরনের উদাসীনতা।
এই বাজারে নিত্যপণ্য আর কিছু ওষুধে দোকান আর রাস্তার পাশে মাছের দোকানে ক্রেতাদের মধ্যে এমন ঢিলেঢালাভাব দেখা গেল। তাদের মধ্যে নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করার প্রবনতাও দেখা যায়নি। মনে করিয়ে দিলেও পাত্তা দেওয়ার মত মনোভাব দেখা যায়নি।
আজিমপুর মাতৃসদন হাসপাতালের সামনে আর সেখানকার ওষুধের দোকানেও ক্রেতা দেখা গেছে।
তবে পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (পেট্রোল) মো. সানোয়ার হোসনে জানিয়েছেন, এ সময় অপ্রয়োজনে কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলেই তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আজিমপুর চৌরাস্তায় কিছু পুলিশ সদস্যকে সড়কের মাঝে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এসময় অপ্রয়োজনে কেউ ঘোরাঘুরি করছেন মনে হলেই তাকে ধাওয়া দিচ্ছেন তারা, আবার কাউকে ধরতে পারলে হালকা পিটুনি দিতেও দেখা যায়।
‘অবরুদ্ধ’ এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ। এমনই একজন রিকশাচালক আব্দুল খালেকের দেখা মেলে রাস্তায়।
নাটোরের আব্দুল খালেক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন হাজারীবাগ বৌবাজার এলাকায়।
সকাল ৮টায় রিকশা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন তিনি। দুপুর পর্যন্ত যাত্রী পেয়েছেন একজন, ৬০ টাকায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভাড়া না্ই, কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করছে না।”
একজন রিকশাচালককে দেখা গেলা রিকশায় ঘুমিয়ে রয়েছেন।
মালিবাগ রেল গেইটের কাছে বস্তির বাসিন্দা ঠেলাচালক সোনা মিয়া বলেন, “ সব কিছু স্যার ব্লক হয়ে গেছে। এভাবে ছোট্ট রুমে কতক্ষন বসে থাকা যায়। এখন সকাল ১১টা বাজে। দুইবার রেল গেইটের কাছে গেলাম। কোনো মানুষজন দেখিনি। কিভাবে দিন যাবে জানি না।
‘‘ এই অবস্থা চললে কিভাবে আমরা ঢাকায় থাকব? বাস বন্ধ না থাকলে ঢাকার বাইরে চলে যেতাম, কিন্তু সেই উপায়ও নাই।”
মগবাজার মোড়ে সকাল ৬টা থেকে বসে থেকেও একজন যাত্রীও পাননি রিকশাচালক রহিম উদ্দিন।
প্রতিবেদককে দেখেই রিকশায় ওঠার অনুরোধ করেন রহিম।
“সকাল থেকে একটা ক্ষেপও পাই নাই। উঠেন, যা পারেন দিয়েন।”
মগবাজার থেকে মালিবাগ মোড়ে কত ভাড়া দেত হবে জানতে চাইলে রহিম বলেন, “২০/২৫ টাকা দিয়েন।”
অথচ চারদিন আগেও রহিম এই দূরত্বে ৪০ টাকায় যাত্রী নিয়েছেন।
তাদের একজন শফিকুল ইসলাম বললেন, পাঠাও, উবারের মত অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলোর সেবা বন্ধ রয়েছে। তারপরও জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে রাস্তায় বের হতে হচ্ছে। তেমন যাত্রীর আশঅতেই তিনি সকালে বের হয়েছেন।
“সকালে দুটো ট্রিপের পর আর কাউকে পাইনি। আর কিছুক্ষণ দেখে কাউকে না পেলে বাসায় ফিরে যাব।”
‘একাত্তরের পর আর এমন দেখিনি’
নয়া পল্টনের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী আবদুল জলিলের চোখে পরিস্থিতি অনেকটা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো।
“১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রের পরেরদিনও এমন আমি দেখিনি। ঢাকাকে এখন নিঝুম ভুতড়ে শহর মনে হচ্ছে। ২৫ মার্চের কালরাত্রের পর যেভাবে শহর ছেড়ে মানুষ চলে গেছে গ্রামে, এখন অনেকটা তেমনই।”
কাকরাইলের মোড়ের কাছে একটি ভবনের নিরাপত্তকর্মী আমানউল্লাহ জানান, সশস্ত্র বাহিনী নেমেছে বলে রাস্তা-ঘাটে মানুষজন নেই, সবাই ভয়ের মধ্যে আছে।
“বাড়ির মালিক বলে দিয়েছে ভাড়াটিয়ারা বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না,” বলেন তিনি।
গুলশানে এক রাজনীতিবিদের বাসায় কোয়ারেন্টিন হোম হিসেবে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা, মুখে মাস্ক লাগানো, হাতে গ্লাভস পরিয়ে স্প্রে করার পরই বাড়িতে ঢোকা সম্ভব। অপরিচিতদের প্রবেশেও কড়াকড়ি।
ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী মুজিব মিয়া বলেন, “স্যারের নির্দেশ বাসাটা কোয়ারেন্টিন। তাই সর্তকতা অবলম্বন করা হয়েছে সব দিক থেকে।”
মানুষকে ঘরে রাখার চেষ্টায় পুলিশের ও সিটি করপোরেশনের গাড়ি থেকে দুজনকে এক সঙ্গে ঘুরতে এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে।
রমনা বিভাগের পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল্লাহেল কাফি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুজনকে এক সঙ্গে ঘোরাফেরা করতে নিষেধ করা হচ্ছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে।
“পুলিশের প্রত্যেকটা ডিউটিরত গাড়ি থেকে এই মেসেজ দেওয়া হচ্ছে। নিত্যপণ্য ছাড়া আর কোনো দোকান খোলা রাখা যাবে না এই বার্তাও দেওয়া হচ্ছে।”