স্কুল জীবনে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এই শিক্ষাবিদ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত লড়ে গেছেন অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ নির্মাণে।
পরিবারের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, চার বছর আগে ছেলে অভিজিৎ রায়কে হারানোর শোক শরীরিকভাবে কাবু করে ফেললেও শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নির্ভিক, দৃঢ়চেতা, মুক্তমনা।
রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মারা যান শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায়। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সহসভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম ছাত্রজীবনে অধ্যাপক অজয় রায়কে পেয়েছেন শিক্ষক হিসেবে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা অজয় রায়ের সঙ্গে পারিবারিক নানা কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ততা ছিল সোসাইটির এখনকার চেয়ারপারসন মাহফুজার।
তিনি বলেন, “ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সব আন্দোলনে স্যার সামনে ছিলেন। আমৃত্যু তিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।”
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বিজ্ঞান সাময়িকীর সম্পাদক ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়।
অজয় রায় তার অসুস্থ স্ত্রী শেফালী রায়ের কতটা যত্ন নিতেন, সে কথাও বলেন তার ছাত্রী মাহফুজা।
১৯৩৬ সালের ১২ মার্চ দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করা অজয় রায়ের শৈশব কেটেছে কলকাতায়। সেখানকার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্কুলে পড়েছেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত।
সেসব দিনের কথা স্মরণ করে ২০১৬ সালে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অজয় রায় বলেন, ”দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কলকাতায় জাপানিদের বোমা পড়া শুরু হলে আমরা দিনাজপুরে ফিরে আসি।”
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনের জড়ানোর কথাও সেই অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন অজয় রায়। সে সময় তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (সিপিআই) ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত।
১৯৫১ সালে মহারাজা গিরিজা নাথ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন অজয় রায়। একটি কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার কারণে কলেজে থাকা অবস্থায় কয়েক মাস জেল খাটতে হয়েছিল তাকে।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “বাবা উকিল থাকায় জামিনে খালাস পেতে অসুবিধা হয় নাই।”
অজয় রায় ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর পর প্রথমে দুই বছর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা করেন । ১৯৬০ সালের শুরুতে যোগ দেন নিজের পুরনো শিক্ষায়াতন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে।
অন্য চাকরি রেখে শিক্ষকতায় আসার কারণ ব্যাখ্যা করে এক সময় তিনি বলেছিলেন, ”আমি চেয়েছিলাম, এমন এক প্রফেশনে যাব, যেখানে গবেষণা করা যাবে- আমি যেগুলো নিয়ে পড়াশোনা করেছি, সেগুলো নিয়ে।”
ষাটের দশকেই অজয় রায়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন অধ্যাপক মাহফুজা খানম।
তিনি বলেন, “বিষয়ের জ্ঞানে উঁচুমানের পদার্থবিদ ছিলেন স্যার। কিন্তু তার জ্ঞানের পরিসর যদি বলি, সাহিত্য, ইতিহাস থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল উনার। যে কোনো বিষয়ে লিখতে দিলে খুব সহজে সুন্দরভাবে লিখে দিতে পারতেন।”
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে সরে যান অধ্যাপক অজয় রায়। এরপর কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান এবং পরিবার রেখে ফিরে আসেন রণাঙ্গনে।
যুদ্ধের মধ্যেই কলকাতায় ডাক পড়ে অজয় রায়দের। সেখানে গিয়ে শতাধিক শিক্ষক মিলে গড়ে তোলেন ’বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’।
প্রয়াত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ আর মল্লিককে সভাপতি করে গঠিত প্রবাসী ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক অজয় রায়। শিক্ষকদের এই মোর্চা বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
সেসব দিনের কথা স্মরণ করে ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে অজয় রায় বলেছিলেন, ”আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সশস্ত্রভাবে অংশগ্রহণ।”
অধ্যাপক অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অবসর নেন ২০০০ সালে; এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক পদে আসেন।
তাকে প্রথমে শিক্ষক ও পরে সহকর্মী হিসাবে পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। কেবল পদার্থ বিজ্ঞানে তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না।
”বিজ্ঞানের বাইরে ইতিহাসবেত্তা হিসাবে উনার জ্ঞানের গভীরতা ছিল। শিক্ষা আর ক্লাসরুমের বাইরেও নানা কর্মকাণ্ডে উনার বিচরণ ছিল।”
আর ব্যক্তি অজয় রায়কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তার সাবেক সহকর্মী বলেন, “অসাধারণ ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। তার সংস্পর্শে যারাই এসেছে, তার বন্ধুবাৎসল্য আর আচরণ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। মনে-প্রাণে-কাজে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তিনি, যেটা হওয়া এত সহজ নয়।”
‘ছেলের লাশের সামনেও চেতনায় দৃঢ়’
বাংলা ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন মুক্তান্বেষার প্রধান সম্পাদক অজয় রায়ের উদ্যোগেই একুশ শতকের গোড়ায় মুক্তমনা ব্লগ প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি ছিলেন ওই ওয়েবসাইটের অন্যতম উপদেষ্টা। পরে তার বড় ছেলে অভিজিৎ রায় মুক্তমনার দায়িত্ব নেন।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি উগ্রবাদীরা যখন প্রবাসী অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে, তখন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন অধ্যাপক অজয় রায়।
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে কঠোর আন্দোলনের ডাক দেন তিনি।
সেই সময়ের কথা স্মরণ করে মাহফুজা খানম বলেন, “অভিজিৎকে হত্যার পর টানা চার দিন তার সঙ্গে ছিলাম আমি। সে সময় তার যে মনের জোর এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় যে দৃঢ়তা আমরা দেখেছি, সেটা এখনো স্মরণ করার মত।”
মানসিক দৃঢ়তার জায়গায় ‘প্রিয় স্যারকে’ জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে ’আইডল’ হিসাবে মানেন ডাকসুর এই সাবেক ভিপি।
অভিজিৎকে হত্যার আট মাসের মাথায় তার বইয়ের প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকেও কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা।
এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে সে সময় এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক অজয় রায় বলেছিলেন, “যতদিন না অভিজিৎ ও দীপন হত্যার নায়কদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারছি, ততদিন পর্যন্ত আমার সংগ্রাম চলবেই, চলবেই, চলবেই।”
শিক্ষায় অবদানের জন্য একুশে পদক পাওয়া অজয় রায় ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। শেষ সময় পর্যন্ত এই সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, "অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার বিচারের বিলম্বের কারণে রায় দেখে যেতে পারেননি তার বাবা অজয় রায়। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।"
অধ্যাপক অজয় রায়ের লেখা বইয়ের মধ্যে ‘Concepts of Electricity and Magnetism’, ‘বাঙালির আত্মপরিচয়: একটি পুরাবৃত্তিক ও নৃতাত্ত্বিক আলোচনা’, ’আদি বাঙালি: নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’, ‘বিজ্ঞান ও দর্শন’, ’জড়ের সন্ধানে’ অন্যতম।
চার খণ্ডের পদার্থবিদ্যা এবং বাংলা একাডেমির বিজ্ঞান বিশ্বকোষ রয়েছে তার সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে।