ইসির ভেতরের দ্বন্দ্ব ‘বাইরে আনা ঠিক হয়নি’

নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কমিশন সচিব ও চার নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে আনাকে সমর্থন করছেন না সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও আবু হাফিজ।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2019, 06:48 AM
Updated : 27 Nov 2019, 11:25 AM

তারা বলছেন, ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন কার্যকর হওয়ার পর আগের দুই মেয়াদের মোট দশ বছরে সচিবের সঙ্গে তাদেরও কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলেও তা কখনও প্রকাশ্যে আসেনি।

কর্মচারি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, ইসি সচিবালয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে, যা এতদসংক্রান্ত সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কমিশন কার্যপ্রণালী বিধিমালা সমর্থন করে না। এবিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে ইউও নোট দেওয়া হয়।

এরপর ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জানান, শতভাগ আইনসম্মত ও স্বচ্ছভাবে কাজ করা হয়েছে; সংবিধান, আইন, বিধি ও নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয়েছে।

সাবেক দুই নির্বাচন কমিশনার বলেন, অভ্যন্তরীণ আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্থাটির কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। কিন্তু হঠাৎ পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে মানুষের মধ্যেও কমিশন নিয়ে অনাস্থা বাড়বে। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন সংশোধনের বিষয়টি নিযে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। সেই সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

মাহবুব তালুকদার জানান, ১৪ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে তার অফিসকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় নির্বাচন কমিশনাররা অভিযোগ করেন যে, কমিশন সচিবালয় কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা সংক্রান্ত ও অর্থ ব্যয় সম্পর্কিত বিষয় কমিশনকে কোনো পর্যায়েই অবহিত করেনি।

ওই সভায় কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর জানান, নিয়োগের বিষয় ও এ সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত।

কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি নির্বাচন কমিশনারদের ‘অবগত করার বিষয় নয়’বলে জানান ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর।

স্বাধীন ইসি সচিবালয় আইনের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরে সচিব বলেন, ইসির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ সিইসির কাছে ন্যস্ত থাকবে এবং সচিব ইসি সচিবালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেখবেন।

“বিষয়টি তো কমিশনারদের কাছে যাওয়ারই কথা নয়, বাইপাস হলো কীভাবে?,” উল্টো প্রশ্ন রাখেন সচিব।

এবিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিইসি ও ইসি সচিবের একক কর্তৃত্ব দেওয়ায় আমরা ওই আইনটি তখনই সংশোধনের জন্য বলেছিলাম। এসব ঝামেলার বীজ তো তখন বপন হয়েছিল। কমিশন একটা কম্পোজিট বডি; ইসি সচিবালয় কমিশনকে সহায়তা করবে। কিন্তু একক নিয়ন্ত্রণ থাকলে স্বচ্ছতা তো প্রশ্নের মুখে পড়বে।”

২০০৭-২০১২ মেয়াদের নির্বাচন কমিশনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, তারা নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধনের বিষয়টি মৌখিকভাবে, লিখিতভাবে সিইসির কাছে দিয়েছেন। অনেক বিষয়ে অবহিত না থাকার কারণে তাদেরও ক্ষোভ ছিল। কিন্তু কখনও বিষয়টি তারা প্রকাশ্যে আনেননি।

এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ওই আইনে ধারা ৫ (৩) ও ১৪-এ সিইসি ও সচিবকে একক ক্ষমতা  দেওয়া হয়েছে। এটা সংবিধানসম্মত নয়; আইনে কিছু ফাঁক রয়েছে।

“এখন প্রকাশ্য কথা হচ্ছে, ঝামেলাও বাড়ছে। সর্বনাশই হবে; ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। কমিশনে দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়।  পাল্টাপাল্টি কথাও ঠিক নয়। আইনটি সংশোধন করতে হবে।”

আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, “আমাদের সময়েও নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব নিয়ে ক্ষোভ ছিল। আমরা বলার পরও আইন সংশোধনটা করেনি। কিন্তু কখনও প্রকাশ্যে বলিনি আমরা।

”নিজেরা আলোচনা করে যতটুকু সম্ভব সমঝোতায় কাজ করেছি। এখনকার পাল্টাপাল্টি  বক্তব্য দেওয়া সঠিক নয়।”

রকিবউদ্দিন কমিশনের এ সদস্য বলেন, “(ঝামেলা তো) ১০ বছর আগে শুরু হয়েছে- এটা তো নতুন কিছু নয়। আইন হওয়ার পর শামসুল হুদা কমিশনেও হয়েছে, আমাদের সময়েও হয়েছে। এটার ধারাবাহিকতা চলছে। তা হলে আইন সংশোধন করা যেতে পারে।

“কিন্তু সংশোধন না হলে সমঝোতা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তা নিয়ে পাল্টপাল্টি বক্তব্য তো দরকার নেই; এ নিয়ে টকশো তে নানা কথা হচ্ছে।”

আবু হাফিজ দুই পক্ষের আইনি ব্যাখ্যাকে সঠিক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনার যা বলছেন; আইনি ব্যাখ্যাও ঠিক। কিন্তু যা বলেননি, তাও ঠিক। মানে খণ্ডিত সত্য বক্তব্য আসছে।

“ইসি সচিব যে আইনের কথা বলছেন, তাও ঠিক। তিনিও যা বলেন নি তাও ঠিক। এটাও খণ্ডিত সত্য। তা হলে বিধানটি সংশোধন বা সহনশীল করা যেতে পারে। নিজেরাই আলোচনা করতে পারে এ নিয়ে।”

নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘অভিযোগ’ ও ‘পাল্টা বক্তব্য ’ গণমাধ্যমে না এনে; কাজ ও ‘এখতিয়ার’ নিয়ে প্রশ্ন না ছুড়ে কমিশনকে বসে সমাধান বের করার আহ্বান জানান তিনি।

এটিএম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময় ‘ইসি সচিবালয় আইন, ২০০৯’ প্রণীত হয়। গেল ১০ বছরে দুটি কমিশন পার হয়েছে। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশনেও  ‘সিইসি ও ইসি সচিবের’ ‘কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ’ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়।

২০১৭ থেকে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশনে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে।