অগ্নিকাণ্ডে অর্ধ কোটি টাকা ক্ষতির হিসাব ইসির

নির্বাচন ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের অন্তত দুই ডজন যন্ত্রাংশ, দুই জোড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও বৈদ্যুতিক তার পুড়ে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে হিসাব কষেছে  ইসি।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2019, 02:43 PM
Updated : 9 Sept 2019, 04:23 PM

ঢাকার আগারগাঁওয়ে ১২ তলা এই ভবনের বেইজমেন্টে আগুন বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে লেগেছিল বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে এবার রক্ষা পাওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ এ ভবনে আগামীতে স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে ইসি জানিয়েছে।

রোববার রাত ১১টায় নির্বাচন ভবনের বেইজমেন্টে আগুন লাগে, এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর তা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

এই ভবনে ভোটারদের ডেটাবেইজের তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে ১১ তলায়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, চার নির্বাচন কমিশনার, সচিবসহ ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কক্ষ রয়েছে; গুরুত্বপূর্ণ নথি রয়েছে। ভবনের নিচ তলায় ইভিএম সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া ব্ল্যাংক স্মার্ট কার্ড সংরক্ষণ ও মুদ্রণ যন্ত্র এ ভবনে রাখার পরিকল্পনা ছিল।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি উইং) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শর্ট সার্কিট থেকে এ আগুনের সূত্রপাত বলে আমরা প্রাথমিকভাবে জেনেছি।

“৫০-৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইভিএমের ১৫-২০টি ব্যালট ইউনিট, ২৫-৩০টি মনিটর, চারটি এসি ও বৈদ্যুতিক কেবলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার তুলনায় খুবই সামান্য।”

অগ্নিকাণ্ডের পর বেইজমেন্ট থেকে সরিয়ে আনা ইভিএমগুলো

ইসির অতিরিক্ত সচিব মো. মোখলেছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “বেইজমেন্টে যেহেতু কেউ বসবাস করে না, সেখানে কোনো হিটার নেই। কাজেই বিদ্যুৎ ছাড়া অন্যকিছু তো দেখছি না।”

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেইজমেন্টে এ অগ্নিকাণ্ড ঘটায় প্রাথমিকভাবে শর্ট সার্কিট থেকে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্য কিছু মনে হচ্ছে না।”

অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপের কারণে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে বলে মনে করেন এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক।

স্পর্শকাতর এই ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষা করতে বলেন তিনি।

অগ্নিকাণ্ড তদন্তে ইসি গঠিত কমিটির সদস্যদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার সাইদুলও রয়েছেন। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ঘাটতি ছিল তদারকিতে

ইসি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনের বেইজমেন্টে আগুন লাগার পর ধোঁয়া বেরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত কেউ টের পায়নি।

ফায়ার এলার্ম কাজ করেছিল কি না, তা নিশ্চিত করা যায়নি। অগ্নি নির্বাপনে বেইজমেন্টে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ছিল কি না, তাও বলছেন না কেউ। বেইজমেন্টের যে বদ্ধ কক্ষে অগ্নিকাণ্ডের সুত্রপাত হয়েছে, তাতে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ছিল না, সেটাও জানা যাচ্ছে না।

ইতোমধ্যে নির্বাচন ভবনে অগ্নিকাণ্ডে করণীয় বিষয়ে মহড়াও হয়েছে। সেক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে কাজ হয়েছে। তবে ভবনের অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা সচল রয়েছে কি না, তা তদারকিতে ঘাটতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে এই অগ্নিকাণ্ডে।

ভবনের নিচ তলায় মিলনায়তন রয়েছে। ভবনের সবখানে ফায়ার এলার্ম রয়েছে। প্রতি তলায় অগ্নিনির্বাপনের ফায়ার হাইড্রেন্ট রয়েছে। আগুন লাগলে কোথাও কোথাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানোর (ফায়ার স্প্রিংকলার) ব্যবস্থাও রয়েছে।

ইসি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে জানান, ফায়ার এলার্ম ও তাৎক্ষণিকভাবে স্বয়ংক্রিয় পানি ছিটানো যন্ত্র কাজ করেনি। রাত ১১টার পর অগ্নিকাণ্ড ঘটায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসেও দ্রুত ঢুকতে পারেনি। দুই প্রধান দরজা তালা থাকায় খুলতে দেরি হয়েছে। অন্যপ্রান্তে কাঁচ ভেঙে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

বেইজমেন্টে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ছিল কি না বা থাকলে কাজ করেছে কি না, সে বিষয়টি তদন্তে উঠে আসবে বলে মনে করছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল।

তিনি বলেন, “রাতে ঘটনাটি হয়েছে। বেইজমেন্টের ওই জায়গায় তো কেউ থাকে না। দমকল বাহিনীর আসার আগে ফায়ার এলার্ম ও সেখানকার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কাজ করেছে কি না, তা বলা যাচ্ছে না। আমরা সব বিষয়ই তদন্তে তুলে আনব।”

আগামীতে এ ভবনের স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে বলে জানান এনআইডি উইং মহাপরিচালক।

“আমরা অটো জেনারেডেট সিস্টেম ডেভেলপ করব। এখন কী ব্যবস্থা ছিল, তা বিস্তারিত জানি না। আগামীতে এমন সিস্টেম করব যাতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। অগ্নিনির্বাপনের বিষয়ে সতর্কতামূলক বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

এক প্রশ্নের উত্তরে ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেন, এ অগ্নিকাণ্ড নাশকতার কোনো ঘটনা নয় বলেই তারা মনে করছেন।

গুরুত্বপূর্ণ নথি ছিল না

এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক জানান, বেইজমেন্টে যেখানে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, সেখানে কোনো কাগজপত্র ছিল না।

“যেখানে আগুন লেগেছে এবং তার পাশে যে রেডিয়াসটা .. প্লাস কেবল পুড়েছে এবং পাশে এসিগুলো পুড়েছে। ”

ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি উইং) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম

ইভিএমের ভেতরের ব্যালট ইউনিট পোড়েনি জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে আমরা আশঙ্কা করছি যে, পানির কারণে যাতে ব্যালটগুলো নষ্ট না হয়। এজন্য আমরা কমিটি এখন সুপারিশগুলো কমিশনকে জানানো হবে, যাতে জাতীয় সম্পদগুলো নষ্ট না হয়।”

ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেন, “পয়েন্ট অব ফায়ার যেটা দেখলাম মেইনলি কেবলের দিকে ফায়ারটা ছড়িয়েছে। যার জন্য উপরের কেবলগুলো পুড়ে গিয়েছে। যে এসিগুলো ছিল সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেবলের বক্সগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ”

তদন্ত কমিটি বসছে মঙ্গলবার

নির্বাচন ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

ইসির অতিরিক্ত সচিব মো. মোখলেছুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটি মঙ্গলবার প্রথম সভায় বসবে।

সোমবার  ইসির উপসচিব (সাধারণ সেবা) রাশেদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়,  তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। 

গঠিত কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন ইসির সহকারী সচিব (সেবা-২) খ ম আরিফুল ইসলাম। চারজন সদস্যের মধ্যে রয়েছেন- জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, গণপূর্তের ই/এম বিভাগ-৮ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিম, গণপূর্ত বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ ইয়ামিন-উল-ইসলাম ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রতিনিধি (পরিচালকের নিচে নয়)।

এই কমিটিকে তিনটি বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কারণ ও উৎস নির্ণয়; অগ্নিকাণ্ডের ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ (আর্থিক মূল্যসহ) এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড যাতে না ঘটে সে সংক্রান্ত সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ইসির পাশাপাশি তাদের তদন্তও চলবে।

“তাতে ভবনের ব্যবস্থাপনা, অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে ভবনে সমস্যা ছিল কি না, তা চিহ্নিত হবে। ইসির তদন্ত কমিটি ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। আমাদের তদন্ত কাজও চলছে। আমরাও সব শেষ করে সুপারিশ পাঠাব ইসির কাছে।”

তিনি জানান, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নির্বাচন ভবনে কেমন ছিল, যা ছিল তা কাজ করেছে কি না, কী কী অসঙ্গতি পাওয়া গেছে, তা ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে থাকবে। আগামীতে কী করণীয় ও প্রয়োজনীয় সুপারিশগুলোও তাতে থাকবে।