তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ধারণক্ষমতার বাইরে রোগী ভর্তি করছে না। ফলে নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্তদের নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছে স্বজনদের।
ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে অন্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতেও সমস্যা হচ্ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
শুক্রবার রাজধানীর মিরপুর, কল্যাণপুর, ধানমণ্ডি, মগবাজার, কাকরাইল ও পুরান ঢাকার আটটি হাসপাতাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩৯০ জন ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছেন ৩৮৬ জন। মশাবাহিত এ রোগে এরইমধ্যে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যদিও সরকারের খাতায় আট জনের মৃত্যুর খবর এসেছে।
আক্রান্ত রোগীদের সবার তথ্য সরকারের নজরদারির মধ্যে আসে না বলে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকের ধারণা।
শুক্রবার দুপুরে ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অন্তত ১০ জনকে ভর্তির জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। তাদের একজনের অবস্থার অবনতি হওয়ায় ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতাল থেকে এখানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেন্ট্রালেও সিট ফাঁকা নেই।
এ হাসপাতালে চিকিৎসকের সাক্ষাত পেতে ঘণ্টাখানেক ধরে অপেক্ষা করছিলেন পঞ্চাশোর্ধ এক নারী। বাসাবোর বাসিন্দা ওই নারী জানান, খিলগাঁওয়ের খিদমাহ হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে শয্যা খালি না পেয়ে তিনি এসেছেন এখানে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “গতকাল প্লাটিলেট কাউন্ট ছিল আড়াই লাখ, আজকে সকালে নতুন করে পরীক্ষার পর দেখা গেছে সেটা দেড় লাখে নেমে এসেছে। আমি এখনও কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারিনি। মনে হচ্ছে আমি মরে যাব।”
সেন্ট্রাল হাসপাতালের উপপরিচালক একেএম মোজাহের হোসেন জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখানে ৯৫ জন ভর্তি আছেন। জানুয়ারি থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত মোট ৭১৫ জন ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছেন
“আমরা ডেঙ্গু রোগীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কিন্তু কোনো সিট ফাঁকা না থাকায় বেশিরভাগকে চিকিৎসাপত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠাতে হচ্ছে। এদের অনেককেই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। ডেঙ্গুকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে অন্য গুরুতর রোগীকেও ভর্তি না নিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে।”
“অনেকে সিভিয়ার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, এটা এবার বেশি। শরীর থেকে রক্ত ঝরলে, ডায়রিয়া শুরু হলে ডেঙ্গুর সিভিয়ার রূপ পাওয়ার বিষয়টি বোঝা যায়।”
কল্যাণপুরে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। ভর্তি হতে অপেক্ষায় আছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত অন্তত ৩৫ জন।
হাসপাতালের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়, প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। বৃহস্পতিবার রাতেই ১২ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের কোনো সিট ফাঁকা না থাকায় অনেকেই সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন।
ছেলেকে নিয়ে এ হাসপাতালে আসা মোহাম্মদ মাজহার নামের একজন বলেন, অবস্থার অবনতি হওয়ায় ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ শুক্রবার একটি সিটের ব্যবস্থা করা হয়।
“আমাদের বাসার পরিবেশ অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছেলে যে স্কুলে পড়ে সেখানেই মশার কামড়ে সংক্রমণ হতে পারে বলে ধারণা করছি।”
ধানমণ্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেলেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক ফয়সাল আহমেদ।
তিনি বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে জরুরি বিভাগে ৪৬ জন রোগী এসেছেন, যাদের ১৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত।
“পরিস্থিতি বুঝে ছয় জনকে ভর্তি নেওয়া হলেও বাকিদেরকে চিকিৎসা দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছি। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় একটি পুরুষ ওয়ার্ডে ৩০টি শয্যা এবং একটি নারী ওয়ার্ডে ৩০টি শয্যা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু রোগীদের রাখা হয়েছে।”
ডেঙ্গু আক্রান্ত স্ত্রীকে এ হাসপাতালে ভর্তি করতে অপেক্ষায় থাকা জাকির হোসেন নামে একজন বলেন, সিটি হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে এখানে এসেছেন তিনি।
“সরকারি হাসপাতালে সিট তো দূরে থাক বারান্দা দিয়েও হাঁটার জায়গা নেই। এখন বাংলাদেশ মেডিকেলে এসেও একই পরিস্থিতি।”
ধানমণ্ডির পপুলার হাসপাতালে এখনও কিছু শয্যা খালি আছে বলে জানালেন একজন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, কিছু অব্যবহৃত কক্ষ ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন তারা। ডেঙ্গু রোগ নিয়ে এসে যারাই ভর্তি হতে চাইছেন, তাদের ভর্তি করে নেওয়া হচ্ছে।
মিরপুরের টেকনিক্যাল এলাকায় বারডেম হাসপাতালের দ্বিতীয় শাখার লজিস্টিকস বিভাগের ব্যবস্থাপক আশরাফুল হক শাওন জানান, ডায়বেটিসের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হলেও তারা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় আলাদা সেল খুলেছেন।
“এখানে ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। ওয়ার্ডে আর কোনো সিট ফাঁকা নেই।”
মগবাজারের রাশমনো হাসপাতালের অভ্যর্থনা কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের স্বজনদের ভিড়। সেখানে কথা হয় গুলবাগের বাসিন্দা আমিরুল ইসলামের সঙ্গে; ডেঙ্গু আক্রান্ত স্ত্রী জান্নাতকে ভর্তি করাতে এসেছেন তিনি।
“কয়েকটা হাসপাতাল ঘুরে আসছি। সিট খালি নাই। এখানেও একটা কেবিন চেয়েছিলাম। কিন্তু পাচ্ছি না। কেবিন নাকি খালি নেই।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের সাধারণ শয্যা ৪৫টি। এছাড়া এনআইসিইউ ও পিআইসিইউ ২০টি, ১২টি আইসিইউ এবং ১২টি সিসিইউ শয্যা আছে। এসব শয্যার বেশিরভাগেই ডেঙ্গু আক্রান্তদের রাখা হয়েছে।
রাশমনো হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপক তামান্না জামান অন্তু বলেন, রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অনেক রোগীকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।
“রোগী অনেক বেশি। আমরা হাসপাতালে জায়গা দিতে পারছি না। অনেককে ওয়েটিংয়ে রেখেছি। ভর্তি রোগীদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু আক্রান্ত।”
এ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক কেশব আচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের হাসপাতালে গত বছরের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি রোগী আসছে। এবার ডেঙ্গু আক্রান্তদের লক্ষণও ভিন্ন।
“আগে ডেঙ্গু হলে রক্তক্ষরণ হত। এখন যেসব রোগী আসছে তাদের অনেকেরই ফুসফুসে পানি, অথবা প্রেসার অনেক কমে যাচ্ছে, অথবা বমি খুব বেশি হচ্ছে।”
হাসপাতালের অভ্যর্থনা কাউন্টারে দায়িত্বরত ইব্রাহিম নামে একজন জানান, শুক্রবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ৩০ জন রোগী ভর্তির জন্য কাগজপত্র জমা দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় ভর্তি করা যাচ্ছে না। অন্তত ২০ জনকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে গেছেন স্বজনরা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, শুক্রবার সেখানে ৮৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন, ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ২০ জন। এর মধ্যে গোলাম কিবরিয়া নামে খিলগাঁও থেকে আসা এক রোগী বৃহস্পতিবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য আলাদা দুটি ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। তাতেও জায়গা না হওয়ায় অন্যান্য ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু রোগীদের রাখা হচ্ছে।
এ হাসপাতালের নবম তলায় নারীদের ওয়ার্ডে কয়েকজন শিশুকেও ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রামপুরা থেকে আসা দীপা ইসলাম জানান, তার তিন বছরের মেয়ের ডেঙ্গু হয়েছে। কয়েকটা হাসপাতাল ঘুরে এখানে এসে ভর্তি করাতে পেরেছেন।
“আমার বাচ্চার অবস্থা ভালো না। ডেঙ্গু খুব খারাপ আকার ধারণ করছে। কিন্তু মশা মারার তো কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখি না।”
তিনি জানান, শুক্রবার ৬০ জন রোগী এসেছেন, যার মধ্যে ৪০ জনই ডেঙ্গু আক্রান্ত। শয্যা না থাকায় তাদের ভর্তি করা যায়নি।
শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে জায়নাফ নামে সাড়ে পাঁচ বছরের এক শিশুকে নিয়ে এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন তার মা-বাবা।
জায়নাফের মা সোমা বলেন, “পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। কাল রাত ১১টা থেকে ঢাকা সিটির সালাহউদ্দিন হাসপাতাল, মিটফোর্ড, ঢাকা মেডিকেল, আসগর আলী হাসপাতাল, সুমনা, নিবেদিতায় গেছি। কিন্তু সিট খালি নাই। বাচ্চার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্লাটিলেট নেমে গেছে এক লাখ বিশ হাজারে। বাসায় রাখলে তো আরও কমে যাবে। এই হাসপাতালের স্যারকে অনেক অনুরোধের পর ভর্তি করে নিছে।”
হাসপাতালের অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সিয়াম হোসেন শান্ত নামে এগারো বছরের এক শিশুকে। শান্তর মা শিল্পী জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী থেকে তারা এসেছেন।
জ্বর হওয়ায় গত সোমবার প্রথমে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎসক। কিন্তু সেখানে ভর্তি করাতে পারেননি।
“হেইখান থেইকা মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়া গেছি। মুগদা থেকে একটা পেরাইবেট হাসপাতালে নিয়া যাই। কোনোখানে ভর্তি করবার পারি নাই। পরে এই হাসপাতালে ভর্তি করাইছে।”