ঢাকায় জোর করে বিয়ে দেওয়া তরুণীর মুক্তি মিলল নিউ ইয়র্কে

স্কুলের থিয়েটারের শিক্ষক ক্যারি এলমান-লারসেন অগাস্টের এক রাতে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের প্রসপেক্ট পার্কের দক্ষিণ পাশের এলাকায় হাঁটতে বেরোন, কয়েক মিনিট যেতেই টানা-হেঁচড়ারত দুই নারী-পুরুষের সামনে চলে আসেন তিনি।

নিউ ইয়র্ক টাইমস
Published : 14 April 2019, 04:49 PM
Updated : 15 April 2019, 03:45 PM

তরুণীকে জোর করে ধরে তার পথ আটকেছিল লোকটি, তার থেকে ছুটতে প্রাণপণ চেষ্টায় ছিল মেয়েটি। তাদের ভাষা না বুঝলেও ‘কিছু একটা ঝামেলা’ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।

এক সময় তিনি জিজ্ঞেস করেন, “সব কিছু ঠিক আছে?”। জবাব দেয় লোকটি, মেয়েটিকে ইঙ্গিত করে বলে, তার স্ত্রী- মানসিকভাবে অসুস্থ।

তবে তার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না এলমান-লারসেন। এরমধ্যে ওই দম্পতিকে ঘিরে দাঁড়ান কয়েকজন লোক। তারা এলমান-লারসেনকে বলেন, “তাকে আমাদের সঙ্গে আসতে দিন। এটা একটি বাঙালি সমস্যা। আমরা তাকে সাহায্য করব।”

তবে সন্দিগ্ধ এলমান-লারসেন চাইছিলেন মেয়েটি তার সমস্যার কথা নিজের মুখে বলুক। এক পর্যায়ে মেয়েটি  ইংরেজিতে বলেন, “জোরপূর্বক বিয়ে। আমি নিরাপদ নই। দয়া করে আমাকে সাহায্য করেন।”

এরপরই সেখানকার এক বাসিন্দা জরুরি সেবার নম্বর ৯১১-এ ফোন করেন। পুলিশ এলে মেয়েটি তাদের কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে অস্বীকৃতি জানান। পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে স্বামীর সঙ্গে বাসায় যেতে বলেন।

তখন এলমান-লারসন পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, এখানে কিছু একটা ঘটছে। আমি ঠিক জানি না বিষয়টা কী, তবে সে (মেয়েটি) যা বলছে তা পুরো ঘটনা বলে আমার মনে হচ্ছে না।”

পরে ওই রাতেই এলমান-লারসনের কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন জাহান নামের ২০ বছরের মেয়েটি।

গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক অভিবাসী নারী ঘরে নিপীড়নের ঘটনা চেপে যান তাদের আর কোনো সুযোগ নেই ভেবে, তাদেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন জাহান। দেশে ফেরত পাঠানোর ভয় ও পরিবারকে বিপদে ফেলা-এসব চিন্তা থেকে নিপীড়নমূলক ওই সম্পর্কের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে চলে ওই নারীদের বসবাস।

জাহান জানান, এই ঘটনার তিন মাস আগে ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন তিনি। ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে ছিলেন জাহান, পড়তেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং।

২০১৭ সালের এক বিকালে জাহানের বাবা-মা এসে তাকে বলেন, অতিথি আসছে এবং তিনি যেন ভালো কাপড় পরে সেজেগুজে নেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ৩০ বছরের আমেরিকান প্রবাসী ছেলেকে নিয়ে বাসায় আসেন এক প্রবীণ দম্পতি। ওই ছেলের সঙ্গে জাহানের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়।

ওই সময়ের ঘটনা স্মরণ করে জাহান বলেন, “আমি এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, শুনেই প্রশ্ন করি, কী?”

“আমি কাঁদতে শুরু করলাম।”

বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের মতো জোরপূর্বক বিয়েও এক বড় সমস্যা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, এদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে।

তবে ১৬ বছরে বিয়ে হওয়া মায়ের চেয়ে ভিন্নভাবে জীবনটা সাজাতে চেয়েছিলেন জাহান। লেখাপড়া শেষ করে স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিলেন তিনি। এর আগেও কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাব এলে সেগুলো বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।

এবার উপায় না দেখে বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। “আমি তাদের বলেছিলাম, দয়া করে এটা করো না। আমাকে কিছুটা সময় দাও। দুই-তিন বছর পর আমি বিয়ে করব। কিন্তু দয়া করে এখন এটা করো না।”

কিন্তু নাছোড় বান্দা বাবা-মা বলতে থাকেন, এখনই বিয়ের সময়।

বিয়ের পর স্বামীর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুই দিনের মধুচন্দ্রিমায় যান এই দম্পতি। বোনের কথা চিন্তা করে জাহানের বড় ভাইও গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে।

ভোর ৪টার দিকে ভাইয়ের হোটেল কক্ষের দরজার ধাক্কা দেন জাহান।

“ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল এবং অঝোরে কাঁদতে ছিল। আমাকে বলে, ভাই, আমাকে বাঁচাও,” টেলিফোনে বলেন জাহানের ওই ভাই।

স্পাউস ভিসার জন্য আবেদন করতে কিছু দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন জাহানের স্বামী। তখন দেশে জাহান তার পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এ বিয়ে থেকে তাকে মুক্তি দিতে।

এক পর্যায়ে ডিভোর্সের জন্য আইনজীবীর শরণাপন্ন হন জাহান। বিষয়টি জানতে পেরে তাকে ‘পতিতা’ বলেও গালি দেয় পরিবারের লোকজন। এরপর তার লেখাপড়া বন্ধ করে ঘরে আটকে রাখা হয়, পাশাপাশি চলে শারীরিক নির্যাতন।

টেলিফোনে ওই ঘটনা স্বীকার করেছেন জাহানের মা ও বড় ভাই।      

বড় ভাই বলেন, “ও খুবই বিমর্ষ ছিল। সে সময় সে যে কোনো কিছুই করতে পারত।”

এরপর নিয়তির কাছে নিজেকে ছেড়ে দেন জাহান। বছর ঘুরতেই তাকে নিতে বাংলাদেশে আসে জাহানের স্বামী। সে সময় তাদের সম্মানে একটি পার্টিও দেওয়া হয় এবং ওই সময় ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে দাঁড়ান জাহান।

 পরে দুজন একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন গত বছর মে মাসে।  

নিউ ইয়র্কের বাসায় প্রথম রাতে জাহান স্বামীকে বলেন, তাদের এখন একজন আরেকজনকে চেনাজানা উচিত। একসঙ্গে সিনেমা দেখা, হাত ধরে শহরে ঘোরা-এসবের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ত এই জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন বলে স্বামীকে বলেন তিনি।

তবে সেগুলোতে সায় ছিল না স্বামীর। তিনি এটাকে দেখতেন বিয়ের অধিকার হিসেবে। কিন্তু জাহানের কাছে বিষয়টি ছিল দুজনের সম্মতির, একসঙ্গে চাওয়ার।

হাতের কব্জিতে নিজেরই করা আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে অসহায় কণ্ঠে জাহান বলেন, “আমি কাঁদতাম, কিন্তু তাতে তার কিছু যেত আসত না।”

উপরন্তু স্বামীর সঙ্গে না থাকলে দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয় তাকে। নিউ ইয়র্কে পা রাখার পরই তার কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়।

সেখানে লেখাপড়া বা কাজ করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয় জাহানকে।

“আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সাও ছিল না। ঘরের চাবিও ছিল না। সে খুবই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছিল,” বলেন জাহান।  

তবে ফোনে জাহানের ওপর কোনো ধরনের নির্যাতনের কথা স্বীকার করেননি তার স্বামী। উল্টো তিনি দাবি করেন, তাকেই জোর করে এই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

জাহানের সঙ্গে কী করে পরিচয় হল জানতে চাইলে তিনি বলেন, পারিবারিকভাবে। কিন্তু বিয়ের সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর দেননি তিনি।  

অগাস্টের ওই রাতে জাহানকে ব্রুকলিনে একটি বাংলাদেশি মেলায় নিয়ে গিয়েছিলেন তার স্বামী। সেখানে জাহানকে হাসিমুখে এবং খুশি খুশি ভাব নিয়ে থাকতে বলেন তিনি। তার কথা মতো জাহানও তা করেন।  সেখান থেকে ফেরার পথে জাহানের মনে হল, তিনি আর এটা বয়ে নিতে পারছেন না। তিনি দৌড়াতে শুরু করেন, কোথায় যাবেন সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ধরে ফেলেন তার স্বামী।

সে সময়ই তাদের সামনে চলে আসেন এলমান-লারসেন। সেখানে কথাবার্তা শেষে সবাই যখন চলে যান, এমনকি জাহানের স্বামীও তখন আবার তার কাছে যান এলমান-লারসেন।  “তাকে সহযোগিতা করার মতো কেউ ছিল না। সে কাউকে চিনত না। আমরা তার কোনো বন্ধুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু তার পরিচিত কেউ ছিল না; তার কিছুই ছিল না,” বলেন ওই নারী।

“এরপর পুলিশ বাংলাদেশে ফোন করলে তার বাবা বলেন, স্বামীর সঙ্গে তার বাসায় যাওয়া উচিত। কারণ স্বামীর সঙ্গে থাকা তার দায়িত্ব।”

তখন ফেইসবুকে এক পোস্ট দেন এলমান-লারসন: “আমার এখন একজন বাঙালি নারী আইনজীবী দরকার।”

তখন দ্রুত সাড়া পান বাংলাদেশি-আমেরিকান মুসলিম ও নারীবাদী আইনজীবী শাহানা হানিফের কাছ থেকে।

এরপর জাহানকে মুসলিম অভিবাসী নারীদের জন্য একটি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। আসিয়াহ নামে ওই আশ্রয়কেন্দ্রটি এর ঠিক একদিন আগেই চালু হয়।

আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠার তিন দিন পর পুলিশের কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন জাহান।

জাহানের জন্য সবচেয়ে বড় সঙ্কট ছিল, তিনি ইংরেজি ভালো পারতেন না। তার নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না, ক্রেডিট কার্ড ছিল না। এমনকি তার ইমিগ্রেশনও স্বামীর উপর নির্ভরশীল ছিল।

পরে ৩৫০ জন নারীর সঙ্গে জাহানকেও যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয় ‘সখি’ নামে আরেকটি কেন্দ্রের সঙ্গে। এখান থেকে শুরু হয় জাহানের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আরেক অধ্যায়।

গত বছর সেপ্টেম্বরে একজন ইমিগ্রেশন আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ হয় জাহানের।

এদিকে সখির মাধ্যমে নতুন একটি আশ্রয় কেন্দ্র খুঁজে পান জাহান, যেখানে প্রায় ছয় মাস কাটিয়ে নতুন একটি অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছেন তিনি।

এরইমধ্যে জাহান ফিরে পেয়েছেন মনোবল। খুঁজে নিয়েছেন একটি চাকরি। একটি ফাস্ট ফুডের দোকানের ক্যাশ সামাল দিচ্ছেন তিনি।

যে জাহান আগে নিউ ইয়র্কের রাস্তা চিনতেন না, তিনি এখন ঠিক জানেন কোন বাসে চড়তে হবে।

একটি কমিউনিটি কলেজে নার্সিং কোর্সে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন জাহান। তবে আপাতত বাড়ি ভাড়া জোগাড়ে কাজে মন দিতে চান তিনি।

কিছুটা মলিন হাসিতে ফিরে আসা আত্মবিশ্বাস নিয়ে জাহান বলেন, “আমি মরে যেতে চাই না। আমি সবাইকে দেখাতে চাই যে, আমিও পারি।”

এদিকে জাহানের সঙ্গে যা হয়েছে তা নিয়ে ফোনে দুঃখ প্রকাশ করেন তার মা। জাহানকে জোর করে বিয়ে দিয়ে তার জীবন নষ্ট করার জন্যও দায়ী করেন নিজেকে।

ডিভোর্স চেয়ে আদালতে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন জাহান। যদিও তার ইমিগ্রেশনের কী হবে, এই নিয়ে এখনও শঙ্কায় তিনি।

সবশেষে তিনি বলেন, “আমি এখন আমার অধিকার সম্পর্কে জানি। কোনো কিছুই আমাকে আর তার (স্বামী) কাছে ফিরিয়ে নিতে পারবে না।”