গুলশান হামলার মামলায় সাক্ষ্য দিলেন হাসনাত করিমের স্ত্রী

গুলশান হামলার মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভীন।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2019, 05:52 PM
Updated : 6 Feb 2019, 05:53 PM

বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শারমিনা ছাড়াও সাক্ষ্য দেন নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল ইসলামের ভাই মো. শামসুজ্জামান ও তার খালাত ভাই মোল্লা মো.আনোয়ারুল আমিন।   
তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেন বিচারক মো.মজিবুর রহমান।

গুলশান হামলার পর সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হাসনাত করিমকে, নেওয়া হয়েছিল রিমান্ডেও। গত বছর অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে কারামুক্ত হন তিনি।

২০১৬ সালের ১ জুন হামলার দিন স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে খেতে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি হাসনাত করিম। পুরো রাত আটকে থাকার পর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারীরা জঙ্গিরা মারা পড়ার আগে বেরিয়ে এসেছিলেন তারা।

সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে শারমিনা বলেন, মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে রাতের খাবার খেতে গুলশানের ওই ক্যাফেতে গিয়েছিলেন তারা।

“হলি আর্টিজানের হল রুমের শেষের টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। মেনু দেখে খাবারের অর্ডার দেই। এর তিন-চার মিনিট পর তিন-চার জন অস্ত্রসহ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করে। তারা গুলি করতে থাকে।”

নজিরবিহীন ওই হামলায় পাঁচ জঙ্গি ছিলেন, ওই রাতে ১৭ বিদেশিসহ ২২ জনকে তারা ক্যাফেতে হত্যা করেছিল। হাসনাত করিমের পরিবারসহ কয়েকজন বেঁচে যান।

হামলাকারী তরুণরা ধর্মীয় পরিচয় জেনে ছাড় দিয়েছিল বলে জানান শারমিনা।

“আমাদের টেবিলের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে, আমরা মুসলিম কি না? আমরা মুসলমান জানালে তারা বলে, আপনারা মুসলমান, আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না। আপনারা মাথা নিচু করে টেবিলে বসে থাকুন।”
সেসময় হলি আর্টিজানের ভেতরে যে কয়েকজন বিদেশি বসা ছিলেন, তারা জঙ্গিদের আক্রমণের শিকার হন বলে জবানবন্দিতে জানান হাসনাত করিমের স্ত্রী।

“বেকারিতে গ্লাস ঘেরা রুমে আনুমানিক আট-দশ জন বা তার বেশি ফরেনার বসা ছিলেন। তাদের ওপর তারা গুলি করা শুরু করে। তারা (জঙ্গি) আমাদের বলে, আপনাদের ছেলে-মেয়েদের চোখ-কান বন্ধ করে রাখেন, যেন তারা কোনো কিছু দেখতে বা শুনতে না পায়। আমি তাদের চোখ-মুখ বন্ধ করে রাখি।”

কমান্ডো অভিযানের পর হলি আর্টিজান বেকারি

রেস্তোরাঁর ভেতরে সারারাত ধরে চলা হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে শারমিনা বলেন, “কিছুক্ষণ পর তারা একটা ছেলে, দুটো কম বয়সী মেয়েসহ চারজনকে আমাদের টেবিলের কাছে নিয়ে আসে। আমাদের সারারাত মাথা নিচু করে টেবিলে বসিয়ে রাখে। বারান্দার একটা লাইট বাদে হলরুমের সব লাইট বন্ধ করে দেয়।

“রাত দেড়টার দিকে একজন ওয়েটার এবং একজন ফরেনারকে বের করে নিয়ে আসে। ওয়েটারকে সরিয়ে ফরেনারকে সরাসরি গুলি করে। আর আমাদের আশেপাশে পড়ে থাকা ডেড বডিগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়।”

ভয়ার্ত পরিবেশের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন,  “রমজান মাস, যখন সেহরির সময় হয়, তখন তারা আমাদের সেহরির ব্যবস্থা করে। পরিস্থিতি খাবার উপযোগী ছিল না। তারা বারবার আমাদের জিজ্ঞাসা করে, খাচ্ছি না কেন? তারা ধমক দেয়, তাই এক কামড় খাবার খেয়েছিলাম। এরপর রাতে আমাদের অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রাখে।”

শারমিনার জবানবন্দি অনুযায়ী ভোরে হাসনাত ও অন্য জিম্মি তাহমিদ হাসিব খানকে ছাদে নিয়ে গিয়েছিল জঙ্গিরা। কিছুক্ষণ পর তাদের আবার টেবিলে এনে বসায়।

সেদিনের কিছু ছবিতে রেস্তোরাঁটির ছাদে হাসনাত করিম ও হাসিবের সঙ্গে জঙ্গিদের হাঁটতে দেখা গিয়েছিল, যা নিয়ে তাদের নিয়েও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল। হামলাকারীদের মধ্যেও ছিল নর্থ সাউথের সাবেক শিক্ষার্থী।

শারমিনা বলেন,  “আমার স্বামীকে চাবি দিয়ে বাইরের গেটের তালা খুলে আসতে বলে। তালা খুলে আসার পর বলে আপনারা এক এক জন করে বের হয়ে যান। বের হয়ে আসার আগে মোবাইলসহ যা যা নিয়েছিল, তা ফেরত দেয়।

“সকাল সাড়ে ৭টার দিকে প্রথমে আমরা আটজন বের হয়ে আসি। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিরাপদ হেফাজতে নিয়ে যায়। পরে আমাদের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।”

ঘটনার পরের মাসে হাসনাতকে আটক করে পুলিশ। দুই বছর ধরে বন্দি থাকার পর এই ঘটনায় তার জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তার আগে তাহমিদ হাসিবও মুক্তি পান।

হাসনাত রেজাউল করিম

জঙ্গি হামলার খবর শুনে ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল।

রবিউলের ভাই শামসুজ্জামান সাক্ষ্যে বলেন, “ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে জানতে পারি আমার ভাই হলি আর্টিজান বেকারিতে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আহত হয়েছেন। তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়ার খবর জানতে পেরে সেখানে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই। বুকের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরে জানতে পারি গুলি ও স্প্রিন্টারের আঘাত।”

এরপর সাক্ষ্য দেন রবিউলের খালাত ভাই আমিন।

৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে এনিয়ে এ মামলায় ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হল।

সাক্ষ্য গ্রহণের দিন আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়।

এ মামলার আট আসামি হলেন- হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ, ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম এবং মামুনুর রশিদ।

হামলাকারী পাঁচ তরুণ রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল কমান্ডো অভিযানে নিহত হন।

মামলাটিতে গত ৮ আগস্ট আট আসামির বিরুদ্ধে দাখিল করা অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত। এর আগে গত ২৩ জুলাই তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক হুমায়ূন কবির অভিযোগপত্র দাখিল করেন।