তিনি বলেছেন, “আমি ধন্যবাদ জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই, বাংলাদেশের জনগণ আমাদের সাথে ছিল, হয়ত আমার দুয়েকজন মন্ত্রী বা উপদেষ্টা ছাড়া সবাই ছিলেন আমার সাথেI এই একটা সিদ্ধান্ত, আপনারা দেখেন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়ে গেছে।”
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে জটিলতার প্রসঙ্গ টেনে এ কথা বলেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়ায় নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব ব্যাংকসহ ‘পশ্চিমা বিশ্বের কিছু নেতা’ পদ্ম সেতু নির্মাণে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের কথা থাকলেও সংস্থাটি দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুললে সরকারের সঙ্গে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে সরকার বিশ্ব ব্যাংককে বাদ দিয়েই সেতুর কাজ শুরু করে।
পদ্মায় বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন আটকাতে মুহাম্মদ ইউনূসের ‘ষড়যন্ত্র’ ছিল বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমি এখনো খুঁজে পাই না; এমডি পদে কি মধু আছে…. যার জন্য এতকিছু করা হলI”
বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সে সময় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের ‘প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন বলেন জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমি তখন সিন্ধান্ত নিলাম এই সেতু নিজের টাকায় করব, কারো অনুদানে নাI আমার অর্থমন্ত্রী, তার ঘোর আপত্তিI”
“আমি যখন এ কথাটা বললাম, বাংলাদেশের মানুষ সকলে জেগে উঠলI আমি চারিদিক থেকে মেসেজ পেলাম, সকলে সাহায্য করতে প্রস্তুতI অনেকই টাকা পাঠানো শুরু করে দিলেন না জেনেইI”
কিস্তু অর্থমন্ত্রীর পাশাপাশি একজন উপেদষ্টাও যে সে সময় আপত্তি করেছিলেন, সে কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
“অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘না, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ছাড়া হবে না’I আমার উপদেষ্টা বলে, ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ছাড়া হবে না’I আমি বললাম, ‘কেন হবে না ? দরকার হলে আমি ডিজাইন চেইঞ্জ করব’I আমি এটা আমাদের নিজের টাকায় করবI অন্য কারো টাকায় করব না।”
দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ওই অভিযোগ নিয়ে ডামাডোলের মধ্যে তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরে যেতে হয়েছিল। দুদক তদন্তে নামার পর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে।
কিন্তু পরে দুদক জানায়, অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা পায়নি। কানাডায় এ বিষয়ে যে তদন্ত চলছিল, সেখানেও একই ফল আসে।
শেখ হাসিনা বলেন, “ওয়ার্ল্ড ব্যাংক লোভ দেয়, অমূককে অ্যারেস্ট কর, তাহলে টাকা দেব। অমুকের বিরুদ্ধে মামলা দাও তাহলে টাকা দেবI স্বাভাবিক ভাবে আমার উপদেষ্টা, আমার অর্থমন্ত্রী যখন বারবার বলেন, কিছু কিছু আমরা শুনলাম, আমরা মানলামI”
বিশ্ব ব্যাংক সে সময় ‘অনেকভাবে প্ররোচিত করলেও’ প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “কষ্ট পেয়েছে আমার ছেলে, কষ্ট পেয়েছে আমার বোনI বারবার আমার ছেলেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে ডেকে নিয়ে থ্রেট করা… আমার মেয়ে চাকরি করত; তার ভিসা না দেওয়া… অনেক অত্যাচার আমরা সহ্য করেছি, মাথা নত করি নাইI”
ইউনূসের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “যে নোবেল প্রাইজের মত একটা প্রাইজ পেয়ে গেছেন, তাক এমডির পদটা ধরে রাখতে হবে কেন? সেখানে কী স্বার্থটা আছে? কী আকাঙ্ক্ষাটা আছে ?
“গ্রামীণ ব্যাংকের আইন আছে ৬০ বছরের বেশি কেউ এমডি পদে থাকতে পারবে না। যার বয়স ৭০ পার হয়ে গেছে, তখনও তিনি এমডি পদ আকড়ে ধরে বসে আছেন।”
সে সময় ইউনূসকে যে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের উপদেষ্টা করার প্রস্তাব হয়েছিল, সে কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
“অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব এবং গওহর রিজভী সাহেব গিয়ে তাকে অনুরোধ করেলন যে, আপনি একজন অ্যাডভাইজার এমিরেটাস হয়ে থাকেন। তিনি সেটা গ্রহণ না করে সরকারের বিরুদ্ধে দুটো মামলা করে দিলেনI”
কিন্তু আদালতের রায় সে সময় ইউনূসের বিপক্ষে যায়। সরে যেতে বাধ্য হন ইউনূস। তারপরও গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি ধরে রাখতে তিনি ‘পশ্চিমাদের দিয়ে সরকারের ওপর চাপ’ দেন বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
“আমার সাথে যখন দেখা হল, তখন ওই একই কথা। টনি ব্লেয়ার যখন (যুক্তরাজ্যের) প্রাইম মিনিস্টার; তার স্ত্রী আমাকে ফোন করল… আমি একই উত্তর দিলাম। বললাম, এখানে আমার কিছু করার নাই, এটা কোর্টের ব্যাপার, আইনের ব্যাপারI তিনি (ইউনূস) তো এতদিন আমাদের কিছু বলেন নাইI এখানে আমাদের কী করণীয় আছেI”
নাম উল্লেখ না করে একজন সম্পাদকের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “এরপর আমাদের দেশেরই একজন এডিটর, ভালোই ইংরেজি জানেন এবং আমাদের ক্লাস ফ্রেন্ডও… সাবসিডিয়ারিতে আমাদের ক্লাস ফ্রেন্ড ছিলেনI
“তিনিও তার সাথে দোসর হলেনI আমেরিকাও চলে গেলেন, হিলারির কাছে বহু ই-মেইল পাঠানো হলো এবং তারই প্ররোচনায় হিলারি নির্দেশ দিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করতে হবেI”
যুক্তরাষ্ট্রের চাপের পরও নিজের অবস্থানে অনড় থাকার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এখানে আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর পর পর যারা তখন ছিল; প্রত্যেকে এসে আমার অফিসে সকলকে একটা হুমকি দিয়ে যেত যে, এমডির পদ থেকে সরালে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ হয়ে যাবেI”
“স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি যখন এসে এই কথাটা আমার সামনে বললেন; আমি তারপর থেকে আমেরিকার কোনো প্রতিনিধির সাথে দেখাই করতাম নাI সম্পূর্ণ দেখা করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমার কথা ছিল, আমার দেশের কোনো অ্যাম্বাসেডর তো প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে পারে নাI আর তারা আসলেই আমরা দেখা করি, এত খাতির করি কেন? যারা আমার দেশের এত বড় প্রজেক্ট বন্ধ করার হুমকি দিতে পারে, তাদের সাথে দেখা করার কোনো প্রয়োজন আমার নাইI”