দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি: বিচারকের প্রতি দুই আসামির অনাস্থা

ন্যায়বিচার ‘না পাওয়ার’ আশঙ্কার কথা জানিয়ে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন এ মামলার দুই আসামি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Sept 2018, 07:36 AM
Updated : 26 Sept 2018, 10:05 AM

আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানের পক্ষে আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ও মো. আক্তারুজ্জামান সোমবার ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামানের প্রতি এই অনাস্থার কথা জানান।

আদালত ও বিচারক পরিবর্তনের জন্য হাই কোর্টে আবেদন করা হবে জানিয়ে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার শুনানি ২০ কার্যদিবস মুলতবির আবেদন করেন তারা।

বিচারক আখতারুজ্জামান বিষয়টি শুনে মঙ্গলবার আদেশের জন্য রেখেছেন। সেই সঙ্গে আসামি মুন্নার জামিন বাড়ানোর আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এদিন এ মামলার প্রধান আসামি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার আবেদন করলে বিচারক আগের মতই কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।

এ মামলার কার্যক্রম চলছে ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বসানো পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে।

এ কারাগারেই আরেকটি ভবনে গত ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

‘অসুস্থতার কারণে’ তাকে গত সাত মাসে একবারও আদালতে হাজির করতে না পারায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ করতে সরকারের নির্দেশে সেপ্টেম্বরের শুরুতে আদালত স্থানান্তর করা হয় কারাগারের ভেতরে।

কিন্তু তারপরও খালেদাকে আদালতে আনতে না পেরে গত ২০ সেপ্টেম্বর তার অনুপস্থিতিতেই বিচার চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেন বিচারক মো. আখতারুজ্জামান।

সেদিন এ মামলার অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক শুনানি আবার শুরু করার জন্য ২৪, ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখ রেখে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুনানির সময় ঠিক করে দিয়েছিলেন বিচারক।

সে অনুযায়ী সোমবার আদালত বসলেও আসামিপক্ষে বিভিন্ন আবেদনের উপর আলোচনায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন আর শুরু হয়নি।

আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন তার দুই আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার ও সানাউল্লাহ মিয়া। আর মামলার বাদী ও তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। এছাড়া ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন।

আদালত বসার পর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তির জন্য দরখাস্ত করে তার ওপর বক্তব্য দিতে শুরু করেন।

মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশের পরও কারা কর্তৃপক্ষ খালেদাকে হাসপাতালে ‘ভর্তি করেনি’ অভিযোগ করে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, “যেহেতু উনি আপনার কাস্টডিতে আছে, সেহেতু আপনি তাকে হাসপাতালে ভর্তির নির্দেশ দেন। আপনি যদি জেলকোডের দোহাই দেন, দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যান, আমরা কোথায় যাব?”

আর বিশেষায়িত হাসপাতালে খালেদার চিকিৎসার পর তিনি ‘সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত’ আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করার আবেদন জানান মাসুদ আহমেদ তালুকদার।

ঢাকায় বিএসএমএমইউতে পৌঁছার পর গাড়ি থেকে নেমে হেঁটেই লিফটে ওঠেন খালেদা জিয়া; স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য শনিবার তাকে কারাগার থেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।ছবি: মাহমুদ জামান অভি

খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এ মামলার বিচার চালানোর যে সিদ্ধান্ত আদালত দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যাওয়ার কথা জানিয়ে মুন্নার আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ২০ দিন সময়ের আবেদন করেন।

একই কারণ দেখিয়ে এ আদালতের বিচারকাজ ৩০ দিনের জন্য মুলতবি রাখার আবেদন করেন মনিরুলের আইনজীবী আক্তারুজ্জামান।

তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মোশাররফ হোসেন কাজল দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আসামীপক্ষের আবেদনগুলোর বিষয়ে আদেশ দেওয়ার আবেদন জানান।

তিনি বলেন, “আপনি আদেশ দিয়েছেন, তার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চলবে। আইনজীবীরা প্রতিনিধিত্ব করবেন; তারা এসেছেনও। কিন্তু উনারা এখন এসে বলছেন, যবে তিনি সুস্থ হবেন, আদালতে আসতে ইচ্ছুক হবেন, তবে বিচারকাজ চলবে।”

দুদকের কৌঁসুলি কাজল এ সময় জিয়াউল হক মুন্নার পক্ষে তার আইনজীবী আমিনুল ইসলামকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের আহ্বান জানান।

আমিনুল তখন আদালতকে বলেন, “যখন কোরাম ছিল, তখন আমরা যথাযথভাবে যুক্তিতর্ক শুরু করেছি। যখন খালেদা জিয়া অন্য একটি মামলায় জেলে, তখন প্রসিকিউশন থেকেও বলা হয়েছিল, আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার চলতে পারে না। বিচার কাজ চলেনি।

“এখন বিচার চালানোর জন্য আপনি যে আদেশে দিয়েছেন, আমরা সেদিনও বলেছি, এটা আইনসম্মত হয়নি। কাস্টডির আসামির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০(এ) ধারা কার্যকর হবে না। যেহেতু আমরা ওই আদেশ দ্বারা এফেক্টেড হচ্ছি, সেহেতু আমরা উচ্চ আদালতে যাব। এ বিষয়টি মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন, কাস্টডির আসামির ক্ষেত্রে ওই ধারা কার্যকর হবে কি-না।”

মোশাররফ হোসেন কাজল তখন বলেন, “যুক্তিতর্কের দিন থাকলেও উনারা যুক্তিতর্ক দিচ্ছেন না। উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যেহেতু উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত নেই- আমরা যুক্তিতর্কের দিকে যাব। প্রয়োজনে আদালতের সময় বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।”

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন না করলে ‘আইনগতভাবে’ মামলার রায়ের দিন ধার্য করার দিকে যেতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ নিয়ে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাদানুবাদের পর বিচারক আখতারুজ্জামান বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি কারাবিধি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। এবং একই ধারাবাহিকতায় তার জামিন বহাল থাকবে।

এরপর আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করতে মুন্না ও মনিরুলের পক্ষের আবেদন নামঞ্জুর করে যুক্তিতর্কের প্রস্তুতি নিতে আইনজীবীদের আধা ঘণ্টা সময় দেওয়ার হচ্ছে বলে জানান বিচারক।

তখন মুন্নার আইনজীবী তার পক্ষ থেকে আদালতের প্রতি অনাস্থার আবেদন প্রসিকিউশনের কাছে দেন। অনাস্থার আবেদন দেওয়া হবে কি-না সে প্রসঙ্গে আসামি মনিরুল ইসলাম খানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ চান আইনজীবী আক্তারুজ্জামানও।

বিচারক সেই সুযোগ নাকচ করলে আইনজীবী আক্তারুজ্জামান উচ্চ স্বরে অনাস্থা আছে কি-না জানতে চান মনিরুলের কাছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দিক থেকে হট্টগোলের মধ্যেই অনাস্থার আবেদন জমা দেন আক্তারুজ্জামান।

আইনজীবী আমিনুল ইসলাম কেন শুরুতে অনাস্থার আবেদন নিয়ে শুনানি করেননি, তা তার কাছে জানতে চান বিচারক।

জবাবে আমিনুল বলেন, “আমরা আস্থা রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কোনো কথা না শুনে বিভিন্ন আদেশ দেওয়া হচ্ছে। আজকেও তাই হল। সেজন্য আমরা এই আবেদন দিচ্ছি।”

এরপর আইনজীবী কাজল আদালতকে বলেন, “উনারা জামিন চাইবেন, আবার অনাস্থার আবেদন করবেন, তা হতে পারে না। আপনি জামিন নামঞ্জুর করে দেন। আর আদালতের কার্যক্রম বন্ধ করতেও আপনি বাধ্য নন।”

তখন অনাস্থার আবেদেনর বিষয়ে আদেশ দিতে মঙ্গলবার দিন ধার্য করে বিচারক জিয়াউল হক মুন্নাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে এজলাস ছাড়েন।