নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এবার পরিবহন মালিকরা গাড়ি না ছাড়ায় সপ্তাহের শেষ দিন রাস্তায় বেরিয়ে বিপাকে পড়েছে রাজধানীর মানুষ।
Published : 02 Aug 2018, 11:20 AM
নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সরকার বৃহস্পতিবার সারা দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। কিন্তু সকাল থেকে রাজধানীর রাজপথে নগর পরিবহনের বাস দেখা যাচ্ছে একেবারেই কম। টার্মিনালগুলো থেকে দূর পাল্লার বাস চলাচলও বন্ধ রেখেছেন মালিকরা।
তারা বলছেন, ধর্মঘটের ঘোষিত কোনো কর্মসূচি তাদের নেই। কিন্তু শ্রমিকরা আতঙ্কের মধ্যে থাকায় এবং নিরাপত্তার কারণে তারা গাড়ি চালাতে পারছেন না।
সকাল থেকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে যানবাহনের অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে বহু মানুষকে। বাস না পেয়ে জীবিকার তাগিদে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন অনেকে।
এমনিতে সকালে ৮টায় উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়কের মোড়ে যাত্রী তোলার জন্য বাসের ভিড় লেগে থাকলেও বৃহস্পতিবার সকালে বাসের সংখ্যা ছিল একবারেই হাতে গোণা।
এয়ারপোর্ট বাসস্ট্যান্ডের অপেক্ষমাণ যাত্রীরা বাসে ওঠার জন্য প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে এসে র্যাব-১ দপ্তরের সামনেও দাঁড়িয়ে ছিলেন।
অন্যদিন বিমানবন্দর গোল চত্বরে সকালে যানবাহনের ভিড় লেগে থাকলেও বৃহস্পতিবার সকালে রাস্তা ছিল অনেকটাই ফাঁকা। একই অবস্থা ছিল খিলক্ষেতে।
বিমানবন্দরের দিক থেকে যখনই কোনো বাস আসছিল, তাতে ওঠার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন অফিসগামী যাত্রীরা। উত্তরা থেকে যারাই বনানী, মতিঝিল বা রাজধানীর অন্য যে কোনো এলাকায় যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছেন, তাদেরই এমন দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।
সকাল ১০টার দিকে উত্তরার দিক থেকে একটি পিক-আপ ভ্যানকে যাত্রী বোঝাই করে মহাখালী বাস টার্মিনালের দিকে যেতে দেখা যায়।
সকালে মোহাম্মদপুর এলাকার চিত্রও ছিলেএকই রকম। বিআরটিসির মোহাম্মদপুর ডিপো থেকে বড্ডার নতুন বাজারের বাস ছাড়ে। কিন্তু সকাল সোয়া ৯টায় ওই ডিপোতে একটি বাসও দেখা যায়নি।
মোহাম্মদপুর বাস ডিপোর বাইরে থেকে অন্যদিন বিভিন্ন গন্তব্যের লেগুনা ছাড়ে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে ওই বাহনও পাননি অফিসগামী যাত্রীরা। ফলে অনেকেই রিকশা ধরার চেষ্টা করেছেন। যারা তা পাননি, তাদের রওনা হতে হয়েছে পায়ে হেঁটে।
মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকা থেকে সকালে আলিফ পরিবহনের বাস রামপুরার বনশ্রীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। মহাখালী এলাকাতেও একই পরিবহনের মোহাম্মদপুরমুখী বাস চলতে দেখা গেছে। কিন্তু অন্যান্য পরিবহনের বাস রাস্তায় নেই বললেই চলে।
মহাখালী এলাকাতেও বহু মানুষকে বাসের অপেক্ষায় দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে একটি বাস কিংবা অটোরিকশা আসতে দেখা গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন সবাই।
উত্তরার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানালেন, প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি কোনো গাড়ি ধরতে পারেননি। একটি অটোরিকশা দেখে দৌড়ে গেলেও চালক সাফ জানিয়ে দেন, তিনি উত্তরা যাবেন না।
বিআরটিসি থেকে ভাড়া করা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) একটি দোতলা বাসকে দেখা যায় কুড়িল বিশ্বরোডের যাত্রী তুলতে। অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েকজনের ওঠার সুযোগ হয়।
মালিবাগ এলাকায় কথা হয় মিরাজ আলীর সঙ্গে। পুরান ঢাকায় যাওয়ার জন্য আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গাড়ি পাননি তিনি।
মিরাজ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই চারদিন কষ্ট পাই, তাও সরকারের যদি শিক্ষা হয়। সরকারি হিসাবেই দেখলাম, গত দুই মাসে বহু মানুষ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এ ধরনের মৃত্যু বন্ধ হওয়া উচিত।”
আজিমপুর থেকে মিরপুর, উত্তরা, কুড়িল, সাভার, নবীনগর, বাড্ডার দিকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছাড়ে প্রতিদিন। অফিস খোলার দিনে ওই এলাকায় অনেক বাসের জটলা থাকার কথা, কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে বাস দেখা যায় হাতে-গোনা। তার বিপরীতে যাত্রীর সংখ্যা অগণিত।
শফিক নামে একজন যাত্রী যাবেন আব্দুল্লাহপুরে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সকাল ৯টা থেকে সোয়া এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি কোনো গাড়ি ধরতে পারেননি।
বাস কম থাকার কারণ জানতে চাইলে আজিমপুরে একটি কাউন্টারের কর্মী বলেন, “আপনারাইতো জানেন, ছাত্ররা আন্দোলন করতেছে, আমাদের গাড়ি ভাংচুর করতেছে। তাই গাড়ি একটু কম নামছে।”
এদিকে ঢাকার টার্মিনালগুলো থেকে আন্তজেলা বাসও ছাড়ছে না বৃহস্পতিবার সকাল থেকে। গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনালে বিভিন্ন গন্তব্যের বাস সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের দারুস সালাম জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাবতলী এলাকা থেকে সকালে দূর পাল্লার বা নগর পরিবহনের কোন বাসই ছেড়ে যায়নি।
“আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। তারপর কিছু গাড়ি ছেড়েছে, কিন্তু সংখ্যা খুব কম “
মহাখালী টার্মিনাল মালিক পরিবহন সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক দাবি করেন, গত তিন দিনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তিন শতাধিক গাড়ি ভাঙচুরের শিকার হয়েছে, ১৩টি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়্ন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন টঙ্গীতে ছাত্ররা নেমে গাড়ি ভাঙচুর করছে। এভাবে কি চলা যায় ? সরকার নিরাপত্তা দিলে আমরা গাড়ি বের করব।”
বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। আমরা গাড়ি চালাতে চাই। কিন্তু চালক বা হেলপার পাই না। আমাদের ঘোষিত কোনো কর্মসূচি নেই।”
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন লিটন হায়দার, সুমন মাহবুব, কামাল তালুকদার, সাজিদুল হক, ওবায়দুর মাসুম, মাসুম বিল্লাহ, তাবারুল হক ও জয়ন্ত সাহা।]