ছুটির দিনে লোকারণ্য গ্রন্থমেলা

ছুটির দিনে মিলেছে ফুরসত; তাই প্রিয় বইয়ের খোঁজে সপরিবারে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ছুটেছেন নগরবাসী; কেউ কেউ আবার এসেছেন প্রত্যন্ত মফস্বল থেকে। 

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2018, 05:48 PM
Updated : 17 Feb 2018, 05:48 PM

শনিবার সকাল থেকে রাত অবধি খুদে পাঠক থেকে মধ্যবয়সী কিংবা ষাটোর্ধ্ব পাঠকও দাপিয়ে বেড়ালেন গ্রন্থমেলা চত্বর। 

সকালে শিশু প্রহরে ইকরি-মিকরিদের সঙ্গে দাপাদাপির পর বিকালে মেলার দ্বিতীয় প্রহরে খুদে পাঠকের দল ঘরে ফিরলো পছন্দের সব বই ঝোলায় পুরে।

নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ইমতিয়াজ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছুটির বিকালে বইমেলায় পাঠকের প্রচণ্ড ভিড় থাকবে জেনেও আজই আসতে হল। মেয়ের বড় বায়না, বইমেলায় যাবে। কী আর করা? আমারও ছুটির দিনে তেমন কাজ নেই। তাই চলে এলাম।”

গাজীপুর থেকে এসেছেন ঊষা তালুকদার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী জানান, ক্লাস-টিউশনির চাপ সামলে নিয়ে আজকে একটু ফুরসত করতেই তিনি এসেছেন মেলায়।

শুধু বইমেলার উদ্দেশ্যেই সিলেট থেকে ঢাকায় এসেছেন এনামুল হাসান মাছুম। তিনি বলেন, “মেলার এই মধ্যভাগে সব নতুন বই প্রায় চলে আসে। এবারের নতুন বইগুলো সংগ্রহ করবো।”

গ্রন্থমেলার দুয়ার খুলে যায় বেলা ৩টায়। সকালে পাঠকের পদভারে এমনিতেই মুখর ছিল মেলা। বিকালে তা যেন রূপ নিল জনসমুদ্রে ! মেলার কোথাও তখন দাঁড়ানোর ঠাঁই নেই। স্টলগুলোতে প্রিয় বইয়ের খোঁজে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে পাঠককে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সিদ্ধার্থ সমাদ্দার বলেন, “মেলায় কোথাও ঠাঁই নেই। চারপাশে এত পাঠক! আজ প্রিয় বইটি খুঁজে পেতে ভীষণ বেগ পেতে হল।”

গ্রন্থমেলার ১৭তম দিনেও মেলার পরিবেশ নিয়ে কয়েজন ক্ষোভ জানালেন। শারিরীক প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর মুগদা এলাকা থেকে মেলায় এসেছিলেন হাসিবুর রহমান।

মেলায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হুইল চেয়ারের বন্দোবস্ত থাকলেও তিনি সকালে এসে কোনো হুইল চেয়ার পাননি বলে অভিযোগ করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভাগ্যিস, আমার গাড়িতে করে মেয়ের হুইলচেয়ারটা নিয়ে এসেছিলাম। নতুবা মেয়েটি বইমেলায় ঢুকতে না পেরে খুব কান্নাকাটি করত। যারা হুইল চেয়ার প্রভাইড করছে, তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।”

শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই নন, এদিন মেলায় আসা অনেক বয়োবৃদ্ধও হুইল চেয়ার না পেয়ে ক্ষোভ জানান।  চত্বরে বেঞ্চিতে বসে থেকে  মেলা উপভোগ করতে হয়েছে তাদের।

আসমা হুদা নামে এক বৃদ্ধা বলেন, “হুইল চেয়ার পাইনি। লাঠিতে ভর দিয়ে হাটতে ভীষণ কষ্ট হয়। ছেলে আমাকে এই বেঞ্চে বসিয়ে রেখে গেছে। তাকে বলে দিয়েছি, কোন বইগুলো কিনতে হবে।”

এদিন মেলায় কথা হল লেখক রিদওয়ান আক্রামের সঙ্গে। ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেও এবারই প্রথম তিনি শিশুদের জন্য দুটি বই লিখেছেন। তার দুই শিশুতোষ গল্পের বই-‘মাছ খাবে ভুতোং’ এবং ‘ব্যাটসম্যান ভুতোং’ প্রকাশ করেছে চিরন্তন প্রকাশ।

শিশুদের  বই নিয়ে তিনি বলেন, “বই মেলায় দেখেছি সমসাময়িক জনপ্রিয় কার্টুন কিংবা অ্যানিমেশন ছবির চরিত্রগুলো নিয়ে বই করা হয়ে থাকে। শিশুরাও এসব বইয়ের জন্য বায়না করে। তবে দিন শেষে এসব বই শিশুর জন্য মননশীল হয়ে উঠে না। এসব ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া দরকার। তাদেরও আসলে কিছু দায়িত্ব থাকে। ভালো বইটি খুঁজে সন্তানের হাতে তুলে দেবার।”

শিশু সাহিত্যিক আহমেদ রিয়াজ জানান, স্কুলগামী শিশুদের শব্দ ভীতি দূর করতে এবার তিনি নয়টি বই লিখেছেন।  তার লেখা ৯টি বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘সুচের খোঁচা’, ‘ঘুঘুর পিপাসা’, ‘ভাস্কর ও ভাস্কর্য’, ‘বৈশাখের বৈকাল’, ‘জঙ্গলে মঙ্গল’। ৯টি বই প্রকাশ করেছে

সেভ দ্য চিলড্রেন, যেগুলো বিনামূল্যে সারা দেশের সাড়ে ৫ হাজার স্কুলে বিতরণ করা হবে।

তিনি বলেন, “প্রথম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইতে ১৮টি যুক্তবর্ণ আছে। যুক্তবর্ণ থাকায় অনেক শিশুর পড়ার গতি কমে যায়। এটাকে যুক্তবর্ণভীতি বলে।

“এই ভীতি দূর করার জন্য প্রত্যেকটা যুক্তবর্ণ দিয়ে যে যে শব্দ আছে, সেগুলো নিয়ে ৬০ থেকে ১০০ শব্দের গল্প তৈরি করা হয়। শুধু তাই নয় প্রতিটা বাক্যে এসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তবর্ণ ভীতি শুধু দূর হবে তা নয়, বরং যুক্তবর্ণগুলোর ব্যবহারও করা শিখবে শিক্ষার্থীরা।”

এছাড়াও আহমেদ রিয়াজ  বাংলাদেশ বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য লিখেছেন ‘লাল বল’ বইটি। এটি বাংলা, চাকমা, মারমা ও ককবরক ভাষায় প্রকাশ করেছে ফুলকি বই কেন্দ্র।

মেলায় ঘুরতে এসে চিত্রশিল্পী হাশেম খান বলেন, “বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর উপর যে বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে সেটাও শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্থ করছে। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আনন্দনিকেতন করে তুলতে হবে সবার আগে।”

মূল মঞ্চের আয়োজন

শনিবার বিকালে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘এ কে এম আহসান , খান শামসুর রহমান, মুজিবুল হক’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এম মোকাম্মেল হক, এনামুল হক এবং অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “এ কে এম আহসান, খান শামসুর রহমান এবং মুজিবুল হক- এদের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন কিন্তু পাণ্ডিত্য, দেশপ্রেম এবং কর্তব্যনিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবাই অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। দেশে ও বিদেশে কর্মসূত্রে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যেমন পালন করেছেন তেমনি দেশের মুক্তি আন্দোলনের নানা পর্বে অবদান রেখেছেন।”

‘ভাষা  সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু’ প্রদর্শনীর উদ্বোধন

নতুন প্রজন্মের সামনে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে নতুনভাবে তুলে ধরতে সুচিন্তা ফাউন্ডেশন বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চের সামনের চত্বরে আয়োজন করেছে‘ভাষা  সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু’ প্রদর্শনী।

এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এমিরেটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্মৃতিচারণ করেন ভাষা আন্দোলনের।   আয়োজনে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।