নারীনেত্রীরা চান সরাসরি ভোট

আইনসভায় সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ বাড়ানো নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখবে না বলে অভিমত জানিয়েছেন নারীনেত্রীরা; স্থানীয় সরকারের মতো সংসদেও নারী আসনে সরাসরি ভোট চাইছেন তারা।

মঈনুল হক চৌধুরীও কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2018, 03:52 PM
Updated : 29 Jan 2018, 04:51 PM

বর্তমানে সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে, যারা পরোক্ষ ভোটে আইনসভায় যান। দলগুলোর পাওয়া ভোটের ভিত্তিতে এই নারী আসন বণ্টিত হয়।

সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ আগামী বছর শেষ হয়ে যাবে বলে তা আরও ২৫ বছর বাড়াতে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনের প্রস্তাব সোমবার মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়।

এর প্রতিবাদে মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংরক্ষিত নারী আসনের ফলে নারী সমাজের রাজনৈতিক ক্ষমতায়তনের ক্ষেত্রেও লাভ হবে বলে মনে হয় না। যা আছে, তা-ই থাকল। তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা জেন্ডার সমতা সেটা কীভাবে হবে?”

সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোট করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিয়ে ক্ষোভ জানান দেশের সবচেয়ে পুরনো নারী সংগঠনের সভাপতি আয়েশা খানম।

আয়েশা খানম

“আমরা গত তিন দশক ধরে সুপারিশটা দিচ্ছি। এই সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেও অঙ্গীকার করেছিলেন যে, সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন, আসন সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ করবেন। অঙ্গীকার করে নেতারা যদি তা না রাখেন, তাহলে এটা এত এক ধরনের প্রতারণা।”

বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য সংরক্ষিত পদে সরাসরি ভোট হলেও আইনসভায় তা হয়নি।

নারীদের সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করতে দীর্ঘদিন ধরে নারী সংগঠনগুলোর দাবি জানিয়ে  আসার কথা বলেন নারীর অগ্রযাত্রায় ‘উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি’র বাংলাদেশ সমন্বয়ক খুশি কবির।

সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনকে ‘অপমানজনক’ও মনে করেন তিনি।

খুশি কবির

খুশি কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা অপমানজনক; কারণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংরক্ষিত আসনের নারীদের ভিন্ন চোখে দেখে। সরাসরি ভোটে না এসে সহজেই নারীরা ৫০টি আসন পাচ্ছেন-এমন মনোভাবও রয়েছে।”

বর্তমানে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্যদের কোনো ভোটার বা সমর্থক না থাকায় দলের বাইরে তাদের কোনো অঙ্গীকার থাকে না বলে মনে করেন তিনি।

খুশি কবির বলেন, “সংরক্ষিত নারী আসন কোনো কাজে আসছে না, খামাখা এটি বাজেটের উপর চাপ বাড়াচ্ছে। কেননা সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যরা সংসদে কোনো কথা বলতে পারে না। পার্টির বাইরে তারা কোনো বক্তব্য রাখতে পারে না। তাদের যদি নির্দিষ্ট ভোটার ও সমর্থক থাকত, তাহলে তাদের জবাবদিহির জায়গাটা নিশ্চিত হত।”

সরাসরি নির্বাচন ছাড়া শুধু মনোনয়নের মাধ্যমে নারীরা তেমন সুফল পাবে না বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালও।

সুলতানা কামাল

তিনি বলেন, “নারী আসন সংখ্যা যতই বাড়ানো হোক, সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা না থাকলে নারীর অংশদারিত্বও নিশ্চিত হবে না। নারীরা এ আসনের সুফলটাও পাবে না।”

সংরক্ষিত আসনগুলোতে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা না থাকায় সংসদে নারীদের এই প্রতিনিধিত্ব কার্যকর হচ্ছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের পরিচালক সারা হোসেনও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরাসরি নির্বাচিত হলে, তারা এলাকার জনগণের সাথে দায়বদ্ধ থাকেন। কিন্তু সংসদের ব্যাপারে আমরা যেটা দেখছি, যারা সংরক্ষিত আসনে আসছেন, তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি নাই, দায়বদ্ধতার জায়গাটা নাই।”

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারী সংরক্ষিত আসনের ফলে কার্যকরী রিপ্রেজেন্টেশন রাখার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে যাচ্ছে।”

তবে সংরক্ষিত নারী আসন নারী নেতৃত্বের জন্য সহায়ক বলে মনে করছেন প্রিপ ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সমাজকর্মী অ্যারোমা দত্ত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বক্তৃতা সবাই দিতে পারে কিন্তু বাস্তবতাটা হচ্ছে, এটি লাগবে। সংরক্ষিত আসনের নারীদের তার এলাকাটার দায়িত্বটা দিয়ে দিতে হবে, না হলে দায়বদ্ধতাটা থাকে না। আমি মনে করি এটি নারীদের জন্য খুবই সহায়ক হবে।”

অ্যারোমা দত্ত

সংরক্ষিত নারী আসন এখনই উঠিয়ে না দেওয়ার পক্ষে অবস্থান জানিয়ে অ্যারোমা দত্ত বলেন, “আসলে সময় লাগবে তো, এটা না থাকলে আমরা জিরো হয়ে গেলে আমাদের নারীদের রিপ্রেজেন্টেশনটা থাকবে না তো।”

বেসরকারি সংস্থা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংরক্ষিত আসন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা থাকবে। কিন্তু  বাস্তবতা হলো সম্ভব হলে আরও আসন বাড়ানো দরকার নারীদের জন্য।”

তিনি জানান, বতসোয়ানায় ৫০ শতাংশ ও অ্যাঙ্গোলায় ৫৩ শতাংশ সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নারীদের প্রতিনিধিত্বে পিছিয়ে এখনও বাংলাদেশ।

সরাসরি ভোটের জন্য ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে ১৯৭৩ সালে ১৫ আসন ছিল সংরক্ষিত নারী আসন। পরে তা বাড়িয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, ষষ্ট ও সপ্তম সংসদে ৩০টি আসন করা হয়।

সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের দাবিতে মহিলা পরিষদের কর্মসূচি

আইনের মেয়াদ না থাকায় চতুর্থ সংসদে ছিল না সংরক্ষিত নারী আসন।

মেয়াদ না থাকায় অষ্টম সংসদের শুরুতেও ছিল না নারীদের সংরক্ষিত এ আসন। তবে ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্থদশ সংশোধনী এনে আসন বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়।

নবম সংসদেও ছিল ৪৫ আসন। এ সংসদেই ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীতে আরও ৫ আসন বাড়িয়ে সংরক্ষিত আসন করা হয় ৫০টিতে।

এবার মেয়াদ বাড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় আলীম বলেন, “আসনও বাড়ানো উচিৎ তবে চেহারা দেখে বা দলের পরিচয়ে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন না দিয়ে প্রকৃত অর্থেই যোগ্যদের বাছাই করা দরকার।”

দলীয় মনোনয়ন, দলীয় গঠনতন্ত্র ও আরপিও মেনে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন আলীম।

নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সংসদের নির্বাচনী আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-আরপিও’ অনুযায়ী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য ২০২০ সালের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার কথা রয়েছে।

এই সম্পর্কিত আরও খবর