কর্মক্ষেত্রে সরব নারী ‘নেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে’

নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নারীরা কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশের পুরুষপ্রধান সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের নগন‌্য অবস্থান এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2016, 05:04 PM
Updated : 16 Nov 2016, 04:24 PM

মঙ্গলবার বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে মুস্তাফিজুর রহমান খান ও সালেহা বেগম ট্রাস্ট ফান্ড স্মারক বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদেকা হালিম তার গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন।

তিনি বলেন, “পুরুষ প্রধান রাজনৈতিক কাঠামো এবং কুসংস্কারের কারণে নারীরা কর্মী হিসাবে সরব থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণ নগণ্য।

“অবিভক্ত বাংলার কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, ৮০ দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা ভূমিকা রাখলেও নারীকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করার মূল্যবোধ সীমিত পরিসরে কাজ করে।”

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়লেও তার সঙ্গে ভোটারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকার কথা তুলে ধরেন এই অধ‌্যাপক।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণকারী নারীর সংখ্যা কমে যাওয়ার পরিসংখ‌্যানও তুলে ধরেন তিনি।

২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে ২৯০০ নারী অংশ নিলেও ২০১৪ সালে তা কমে ১৫০৭ জনে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১ লাখ ৮০ হাজার নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ২০০৩ সালে ১ লাখ ২৪ হাজার এবং ২০১১ সালে তা ৯০ হাজার জনে কমে আসে।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বিশ্বজুড়ে নারী অধস্তনতার উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা বলেন সাদেকা হালিম।

“হিলারি (ক্লিনটন) কেন হারল? কারণ তিনি একজন নারী। নারী এগিয়ে যেতে থাকলে সেখানে পুরুষদের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়ে যায়।”

“সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচন। সেখানেও দেখা যাবে, পুরুষদের ঠেলায় নারীরা দাঁড়াতে পারবে না,” দেশের প্রসঙ্গে ফিরে এবার নিজের কর্মস্থলের কথাই বলেন তিনি।

দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর প্রশাসনের কম সংখ‌্যায় থাকার তথ‌্যও উঠে আসে এই অধ‌্যাপকের গবেষণায়।

সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীর হার ৭ দশমিক ৬ ভাগ। উপ-সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত এই হার ১ শতাংশ বা তারও কম। বিচারকদের ১০ শতাংশ নারী।

“প্রধান বিচারপতি পদে কোনো নারীকে দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিশনার পদে কোনো নারীকে দেখা যায়নি।”

সাদেকা হালিম বলেন, নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ। যতক্ষণ তারা নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে না, ততক্ষণ তাদের এই অবহেলিত অবস্থা চলতে থাকবে।

ভূমি মালিকানায়ও বঞ্চিত নারী

সাদেকা হালিম বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী ভূমিহীন এবং তারা সরাসরি ভূমি ব্যবস্থাপনায় নেই।

পুরুষরা দেশের ৯৬ শতাংশ জমির মালিক, বাকি চার ভাগ নারীদের। প্রথাগতভাবে মুসলিম ও অভিজাত হিন্দু নারীদের ‍ভূমির মালিকানা থাকলেও তারা মাঠের কাজে বা দেখাশোনায় থাকেন না। পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা জুম চাষ করলেও ভূমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত।

“সম্পত্তিতে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করাই বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসাবে দাঁড়িয়েছে,” বলেন তিনি।

মূলধারায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মতো ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও সেখানেও বঞ্চনার চিত্র উঠে আসে এই গবেষণায়।

নারীরা খাদ্য উৎপাদনে নিয়োজিত থাকলেও ২০১৫ সালে দেওয়া ১ কোটি ৩৯ লাখ কৃষক কার্ড নারী কৃষকদের কেউ পায়নি। পারিবারিক শ্রমের ব্যবহারিক মূল্য থাকলেও অর্থনৈতিক মূল্য নেই। জিডিপিতেও তা ধরা হয় না। ২০০৫-০৬ সালের হিসাব অনুসারে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার ৭৭ শতাংশ নারী হলেও তাদের কম বেতন পাওয়া অব্যাহত রয়েছে।

পোশাক শিল্পসহ দেশের অর্থনীতির চালকের আসনে থাকা বিভিন্ন খাতে নারীর ব‌্যাপক অংশগ্রহণ হলেও এসব খাতে নারীর ক্ষেত্রে মজুরি বৈষম‌্যের কথা বলা হয় গবেষণাপত্রে।

বৈবাহিক ধর্ষণ, অন্য নিপীড়নও

সমাজের নানা স্তরে লিঙ্গীয় সহিংসতা তুলে ধরতে গিয়ে একটি জরিপের ফল সবার সামনে তুলে ধরেন সাদেকা হালিম।

৬৫ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক, ৫৩ শতাংশ অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার।

“আইনগত প্রতিকারের বিধান না থাকায় মেরিটাল রেইপ নিয়ে কথা বলা যাচ্ছে না।”

অর্থনৈতিক নির্যাতনের প্রসঙ্গ টানতে গিয়ে নাম প্রকাশ না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের এক সহকর্মীর দৃষ্টান্ত দেন সাদেকা হালিম।

“মাস শেষ হওয়ার পর ওই নারী শিক্ষকের স্বামী তার থেকে পুরো মাসের বেতন নিয়ে নেয়। আরও অনেকের স্বামীকে ব্যাংকে গিয়ে চেক নিয়ে বসে থাকতে দেখেছি।”

তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন মাত্রায় নারী নির্যাতনের কথাও আসে সাবেক তথ‌্য কমিশনার সাদেকা হালিমের গবেষণায়।

সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে ২০১০ সালে ৮ জন, ২০১১ সালে ১৫ জন, ২০১২ সালে ১৯ জন এবং ২০১৩ সালে ২৩ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।

“এই হার বাড়ছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় অশ্লীল বক্তব্যকে অপরাধ বলা হলেও নারীর বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে ব্যবহার হচ্ছে না।”

ধর্ষণের খবরে ‘গণধর্ষণ’ শব্দ নিয়ে আপত্তি জানান সাদেকা। এর পরিবর্তে ‘দলগত ধর্ষণ’ ব‌্যবহারের পক্ষে মত দেন তিনি।

বিচারেও বঞ্চনা

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে হাই কোর্টের একটি নির্দেশনা থাকলেও ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সেটা জানেই না বলে একটি জরিপে পাওয়া তথ‌্য তুলে ধরেন সাদেকা হালিম।

অধ্যাপক সাদেকা হালিম

তিনি বলেন, “৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মতে যৌন হয়রানির বেশিরভাগ ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ওরিয়েন্টেশনেই লাইব্রেরি ব্যবহার শেখানো সঙ্গে সঙ্গে যৌন নিপীড়নের প্রতিকারের বিষয়টিও বলে দিতে হবে। উন্নত বিশ্বে তাই হয়। অক্সফোর্ড অব দ্য ইস্ট বললেও আমরা সেটা করি না।”

সাদেকা হালিম বলেন, “ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে নির্যাতনের পর পুনরায় মানহানি ও হয়রানির ভয়ে এগুতে চায় না। আর বিচারপ্রাপ্তি ১ শতাংশ। কোন নারী ধর্ষিত হলে তাকেই তা প্রমাণ করতে হয়। বাড্ডায় এক গারো নারী ধর্ষিত হওয়ার পর অভিযোগ করতে তাকে তিন থানায় ঘুরতে হয়েছে। যাতে আলামত অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে।”

সামনে এগোতেও পেছনের বাধা

একটি সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য হলেও স্বাধীনতার চার যুগেও বাংলাদেশে ধর্ম, গোষ্ঠী, শ্রেণিতে বারবার হোঁচট খেয়েছে নারী-পুরুষের সমতার আন্দোলন, বলছেন সাদেকা হালিম।

তিনি বলেন, বাঙালি-আদিবাসী, মুসলিম-হিন্দু, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণিতে নারীর অগ্রগতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, এমনকি কোনো কোনো বিষয়ে অগ্রগতি হওয়ার পর আবার পেছন যাত্রা হয়েছে।

যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ

স্বাধীনতার পর প্রণীত বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উল্লেখ করে জিয়াউর রহমানের আমলে তার পরিবর্তনকে পেছনে হাঁটার যাত্রা হিসেবে তুলে ধরেন এই অধ‌্যাপক।

“তার ফলে কট্টর ইসলাম ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরে যাকে আরেও মজবুত করেন এরশাদ (এইচ এম এরশাদ)।”

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতিতে সম্পদ, উত্তরাধিকার, ভূমির উপর নারীর অধিকার নিশ্চিত হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, “কিন্তু ২০০৪ সালে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নারী নীতি সংশোধন করে এ সংক্রান্ত ধারাটি বাতিল করে দেয়।”

২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতিতে ফিরতে চাইলেও মৌলবাদীদের বাধার মুখে পড়ার কথা তুলে ধরেন তিনি।

এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নারী নীতি ২০১১ গৃহীত হলেও সেখান থেকে সম্পদের উত্তরাধিকার বণ্টনে সম অধিকার বাদ দেওয়ার কথাও আসে সাদেকা হালিমের কথায়।

“এই পর্যায়ে এসে সমাজ ও সাংবিধানিক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন সংশোধনে দলটি কী কী পদক্ষেপ নেবে, তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।”

তিনি বলেন, নারীর সার্বিক উন্নয়নে ধর্মকে বাধা হিসাবে ব্যবহারের ধারাবাহিকায় ২০১৩ সালে মতিঝিলে হেফাজত যে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরে সেখানে নারীর প্রতি বিদ্বেষ নগ্নভাবে পরিস্ফুটিত হয়।

“এরা ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করছেন, তারা ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, বরং বলা যায়, রাজনৈতিক স্বর্থোদ্ধার করাই তাদের মূল লক্ষ্য।”

মফিদুল হকের সভাপতিত্বে এই স্মারক বক্তব্যের পর অধ্যাপক সাদেকা হালিম শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।