স্থিতাবস্থা জারি: কাটা যাবে না যশোর রোডের গাছ

ঐতিহাসিক যশোর রোডের চার হাজারের বেশি শতবর্ষী গাছ কাটা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ছয় মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Jan 2018, 07:38 AM
Updated : 18 Jan 2018, 10:47 AM

এই আদেশের ফলে যশোর রোড হিসেবে পরিচিত যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গাছগুলো এখন আর কাটা যাবে না বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার রুলসহ এ আদেশ দেয়।

রিট আবেদনে পক্ষে মনজিল মোরসেদ নিজেই শুনানি করেন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এম এম মনিরুজ্জামান।

মনজিল মোরসেদ পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক চার লেইন করার প্রকল্পে সরকারকে পরিবেশ সংরক্ষণে ‘নিষ্ক্রিয়’ দেখা যাচ্ছে।

সরকারের এ ‘নিষ্ক্রিয়তাকে’ চ্যালেঞ্জ করে ওই সড়কের প্রাচীন গাছগুলোর ‘ঐতিহ্যগত দিক’ তুলে ধরে এই রিট আবেদন করা হয় বলে জানান মোরসেদ।

জানুয়ারির শুরুতে যশোর জেলা প্রশাসনের এক বৈঠকে বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে যশোর পর্যন্ত সড়ক চার লেইনে সম্প্রসারণে দুই পাশের কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর থেকেই সারা দেশে প্রতিবাদ ও সমালোচনা চলছে।

এক সময়ের পূর্ব বঙ্গ থেকে কলকাতা যাওয়ার প্রধান সড়ক যশোর রোডের দুই পাশে দুইশর বেশি গাছ রয়েছে, যেগুলোর বয়স দেড়শর বেশি।

এই গাছগুলো কাটার যুক্তি হিসেবে সড়ক সম্প্রসারণের কথা বলেছে সড়ক বিভাগ; কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংগঠন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও যশোর রোড রয়েছে ঐতিহাসিক অবস্থানে। খুলনা থেকে কলকাতার দমদম পর্যন্ত এই সড়ক ধরেই একাত্তরে লাখো মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে।

তাদের দুর্দশা দেখেই আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’, যা সে সময় বিশ্বকে নাড়া দেয়।

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই সড়ক হয়েই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা থেকে শত্রুমুক্ত যশোরে পৌঁছান। 

হাই কোর্টের আদেশের পর মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত শুনানি নিয়ে ওই মহাসড়কের শত শত শতবর্ষী গাছ কাটার ক্ষেত্রে ছয় মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছে। এ আদেশের ফলে গাছগুলো যে অবস্থায় আছে সে অস্থায় থাকবে, কাটা যাবে না।”

আর গাছ সংরক্ষণে প্রশাসনের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং গাছগুলো সংরক্ষণের জন্য প্রকল্প সংশোধন করে মহাসড়ক চার লেইন করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছে আদালত। 

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সড়ক-মহাসড়ক বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী, যশোরের জেলা প্রশাসক, বেনাপোলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বেনাপোল থানার ওসিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।”

মনজিল মোরসেদ বলেন, “গাছ হল পরিবেশের প্রধান উপাদান। কিন্তু যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে চার লেন তৈরি করতে গিয়ে যদি গাছগুলো কেটে ফেলা হয়, সেক্ষেত্রে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে।

“তাছাড়া শত শত শতবর্ষী গাছ এমনভাবে আছে যা আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশর অন্য কোথাও এরকম দেখা যায় না। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।”

যশোর রোডের গাছ কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কয়েকদিন আগে প্রশাসনকে উকিল নোটিস পাঠিয়েছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে যশোর রোড বলতে দমদম থেকে বনগাঁর পেট্রোপোল সীমান্ত পর্যন্ত মহাসড়ককে বোঝায়; ওই সড়কের পাশে গাছ কাটায় কলকাতা হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে তুলে ধরা হয় সেই নোটিসে। 

এদিকে মঙ্গলবার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যশোর রোডের গাছগুলো রেখেই রাস্তা চওড়া করা সম্ভব।

তাদের ভাষ্য, বিদ্যমান রাস্তার উত্তর বা দক্ষিণ কিংবা উভয় পাশ দিয়ে নতুন রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। সেখানে এক পাশ দিয়ে থাকবে সাধারণ কম গতির যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা। এই রাস্তায় দুই লেইনের মাঝে থাকবে গাছের সারি। সেক্ষেত্রে মাটির কাজও বেশি করতে হবে না।

পাবনা ও সিরাজগঞ্জে এ ধরনের রাস্তা নির্মাণ করে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে জানিয়ে বাপার সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে সড়ক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।