চুলায় গ্যাস আসছে না, ব্যয়ও বাড়ছে

শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাইপলাইনে গ্যাসের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রান্না ঘরে গ্যাসের চুলা না জ্বলায় ব্যয়বহুল বিকল্প পথ খুঁজতে হচ্ছে গৃহস্থালিগুলোকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Jan 2018, 06:10 PM
Updated : 14 Jan 2018, 06:23 PM

শীতে চাহিদা বেড়ে যাওয়াকে সঙ্কটের অন্যতম কারণ হিসাবে দেখাচ্ছেন বিপণন সংস্থা তিতাসের কর্মকর্তারা। ভোক্তা প্রতিনিধিদের দাবি, এটি সরকারি সংস্থাটির সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার একটি চিত্র।

রোববার ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ দিয়ে দেখা যায়, গত তিন দিন ধরে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় গ্যাসের সঙ্কট। কয়েকটির বাসিন্দারা মাসের পর মাস ধরে গ্যাসের দুর্ভোগ পোহানোর কথাও বলেছেন।

ফার্মগেইট, শ্যামলী, আদাবর, মিরপুর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, সেগুন বাগিচা, যাত্রাবাড়ি, পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, লালবাগসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা গ্যাস সঙ্কটের কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন। অনেকে ফেইসবুকেও লিখেছেন গ্যাস সঙ্কটের কথা।

ফার্মগেইটের তৃপ্তি ইলিমা অভিযোগ করেন, তিন দিন ধরে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না পাইপলাইনে। বিকালে এলেও সন্ধ্যা ৬টায় আবার দুই ঘণ্টার জন্য গ্যাস চলে যায়।

সেগুনবাগিচার বাসিন্দা শিরীন রহমান জানান, গ্যাস সঙ্কটের কারণে রান্নাসহ দৈনন্দিন কার্যক্রমের সময়সূচি পরিবর্তন করতে হয়েছে।

“গত পাঁচ-ছয় দিন ধরে সকাল ৮টার আগে থেকেই গ্যাস চলে যায়। বেলা ২টার পর একটু একটু আসে। এ কারণে ভোরে ফজরের নামাযের পরই রান্না শুরু করে দিতে হয়।”

একই পরিস্থিতিতে সম্মুখীন হয়েছেন আদাবরের বাসিন্দা শামীমা পারভীন।

তিনি বলেন, “সকাল ৮টা থেকে গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। বিকাল ৩টার পর আবার গ্যাস আসে। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই পরিস্থিতি। আগে এমন ছিল না।”

শ্যামলী কাজী অফিস এলাকার গৃহিনী সাদিয়া জানান, তাদের এলাকায় সারা বছরই গ্যাসের সঙ্কট থাকে। সম্প্রতি তা তীব্র হয়েছে। রাত ১২টায় গ্যাস আসে সকাল ৬টায় আবার চলে যায়।

যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, যাত্রাবাড়ি-কাজলায় সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পযর্ন্ত গ্যাস থাকে না।

সাইন্স ল্যাবরেটরি এলাকার বাসিন্দা সঞ্চিতা মোস্তাকিম বলেন, “এমনিতে গত কয়েকদিন ধরে গ্যাসের সঙ্কট ছিল, কিন্তু গত তিন দিন ধরে পরিস্থিতি অসহনীয়। সকাল থেকে গ্যাস থাকে না, দুপুরের দিকে যতটুকু পাওয়া যায়, তা দিয়ে রান্নার কাজ করা যায় না।”

শুক্রাবাদের বাসিন্দা জাভেদ হাসান বলেন,“ সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাসের কোনো চাপ থাকে না। বাসায় রান্না হয় রাত ১১টার পর। গত তিন-চারদিন ধরে এই চলছে।”

পুরান ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় জানুয়ারির শুরু থেকেই গ্যাসের সমস্যা বলে জানিয়েছেন একাধিক বাসিন্দা।

সূত্রাপুরের মদন সাহা লেন এলাকার বাসিন্দা গৃহিনী শাহিদা খাতুন জানান, গত প্রায় ১১ দিন ধরে সকাল ১০টা থেকে চুলায় গ্যাসের চাপ কমতে থাকে, দুপুর হতে হতে একদমই থাকে না। বিকাল ৩টার আগে গ্যাস পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, “বাচ্চারা স্কুলে যায়, ওদের টিফিন রেডি করতে সময় লাগে। সকালে তাড়াহুড়ো করে কোনোভাবে করি, নয় তো সেই দুপুর বেলা। রুটিন উল্টেপাল্টে গেছে একদম। গতকাল বাধ্য হয়ে গ্যাস সিলিন্ডার কিনেছি।”

গেন্ডারিয়া এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, সারা বছর তাদের এলাকায় গ্যাস চাপ কম থাকলেও জানুয়ারির শুরু থেকে সঙ্কট প্রকট হয়েছে।

গেন্ডারিয়ার ডিআইটি প্লটের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষিকা শারমিন আলী জানান, গত নয় দিন ধরে ভোর ৬টায় গ্যাস চলে গিয়ে রাত ১২টার দিকে আসে। সারাদিন চুলায় আগুন জ্বালানোর মত গ্যাসও পাওয়া যায় না। এ কারণে বাধ্য হয়েই তিনি এখন গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন।

“গ্যাস সিলিন্ডারের পেছনে খরচ হয় ১২০০-১৩০০ টাকা, আবার গ্যাস বিলও দিচ্ছি ৮০০ টাকা। এদিকে ইলেকট্রিক বিলও বাড়তি আসছে। কারণ পানি গরম করতে হিটার আর রান্নার জন্য রাইসকুকার ব্যবহার করতে হচ্ছে।”

মিরপুর ১২ নম্বর ডি ব্লকের বাসিন্দা সাহানা কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরককে জানান, তাদের এলাকায় সকাল ৭টা থেকেই গ্যাস কমতে থাকে, সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। রাত ১১টার পরে গ্যাস আসতে শুরু করে।

"আমাদের এখানে সব সসময়ই গ্যাসের সঙ্কট। কিন্তু শীতে সমস্যাটা আরও প্রকট হয়েছে। চুলা জ্বলেই না। তাই বাধ্য হয়েই ইনডাকশন ওভেন কিনেছি। গ্যাসের বিল তো ঠিকই দিচ্ছি।”

এ এলাকার আরেক গৃহিনী আসমুনা মোর্তজা বলেন, "কখন গ্যাস আসবে সেই অপেক্ষায় থাকলে তো খাওয়া-দাওয়াই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করছি। দেড়-দু'হাজার টাকা মাসে বাড়তি খরচ হচ্ছে গ্যাসের কারণে। এভাবে কী চলা যায়?”

তিনি জানান, শীতের আগে অন্যান্য সময়ে সকাল ১০টা থেকে দুপুর আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত তাদের গ্যাস থাকে না। এমনকি অনেকসময় সন্ধ্যাতে গ্যাস সংকট দেখা দেয়। আর জানুয়ারীর শুরু থেকে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ১১টা পর্যন্ত গ্যাস একদমই থাকে না।

তিতাসের ব্যাখ্যা

গ্যাস সঙ্কটের কারণ জানতে তিতাসের পরিচালক (অপারেশন্স) এইচ এম আলী আশরাফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শীতে বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের সাপ্লাই আগের মতোই আছে কমে নাই। কিন্তু গ্যাসের ইউজটা বেড়ে গেছে। এজন্য একটুখানি হলেও বিভিন্ন লোকেশানে কম পায়। শীতটা একটু কমলেই সমস্যা কমে যাবে।“

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি

আলী আশরাফ বলেন, শীতে অধিক সময় চুলা জ্বালিয়ে রাখার কারণে গ্যাস খরচ ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে চাহিদার সঙ্গে জোগানের একটা ফারাক তৈরি হয়েছে।

তিতাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা জানান, বর্তমানে তিতাসগ্রাহকদের দৈনিক চাহিদা দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর বিপরীতে তারা  ১৭শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে পারছেন।

“কিছুদিন আগে সাপ্লাই আরও কম ছিল, এখন একটু বেড়ে ১৭শ মিলিয়ন ঘটফু হয়েছে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবির সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, বিপণন সংস্থা তিতাসের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা ঢাকা অঞ্চলের গ্যাস সঙ্কটের জন্য দায়ী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্যাস নিয়ে সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সময় আমরা তিতাসকে তাদের অসঙ্গতি এবং অব্যবস্থাপনাগুলো ধরিয়ে দিয়েছি, কিন্তু কোনো ফল হয়নি।”

এখন শীতকালে যে ভয়াবহ সঙ্কট দেখা দিয়েছে তা তিতাসের সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই হচ্ছে বলে মনে করেন পিন্স।