বিচারপতি জয়নুলের বিরুদ্ধে তদন্ত: রুলের শুনানি শুরু

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে তদন্ত ‘আটকাতে’ দুর্নীতি দমন কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া চিঠি নিয়ে প্রশ্ন তুলে যে রুল দিয়েছিল হাই কোর্ট, তার শুনানি শুরু হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Oct 2017, 04:28 PM
Updated : 19 Oct 2017, 05:09 PM

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চে বৃহষ্পতিবার শুনানির পর আদালত আগামী ২৪ অক্টোবর শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ হয়েছে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টর মইনুল হোসেন।

দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান এবং সুপ্রিম কোর্টের চিঠি আদালতের নজরে আনা আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদিউজ্জামান তরফদারও শুনানিতে ছিলেন।

২০০৯ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসরে যাওয়া বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের কথা উল্লেখ করে তার বিষয়ে তথ্য চেয়ে সুপ্রিম কোর্টকে চিঠি দিয়েছিল দুদক।

গত ২৮ মার্চ ফিরতি চিঠিতে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, এই বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদকের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ ‘সমীচীন হবে না’।

সুপ্রিম কোর্টের ওই চিঠি কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে গত ৯ অক্টোবর রুল দিয়েছিল হাই কোর্ট।

রুলের শুনানির জন্য অ্যামিচি কিউরি হিসেবে আদালত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, এ এম আমিন উদ্দিন ও প্রবীর নিয়োগীকে নিয়োগ দিয়েছিল।

নিয়োগ পাওয়া এই তিন অ্যামিচি কিউরি আদালতে উপস্থিত থাকলেও তারা বৃহস্পতিবার শুনানিতে অংশ নেননি।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “একজন বিচারক সাংবিধানিক পদে ছিলেন বলে তিনি দায়মুক্তি পেতে পারেন না। আমি সাংবিধানিক পদে আছি বলে আমি আইনের উর্ধ্বে নই।

“বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৫ সালে যেমন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, এই চিঠিও ঠিক তেমন, দায়মুক্তির।”

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনা করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা ওই চিঠির প্রসঙ্গটিও এনেছিলেন।

মাহবুবে আলমও বলেন, “ফুল কোর্টের সিদ্ধান্ত ছাড়া প্রধান বিচারপতি এভাবে চিঠি দিতে পারে না। এ চিঠি দেওয়ার এখতিয়ার নেই প্রধান বিচারপতির। এ চিঠির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে।”

এসময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চায়- সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক কোনো আদেশের বিচার করার এখতিয়ার হাই কোর্টের আছে কিনা?

সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ষোড়শ সংশোধন অবৈধ

 

জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “ক্ষমতা বহির্ভূত কোনো আদেশ দেওয়া হলে তা দেখার এখতিয়ার হাই কোর্টের রয়েছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। উপযুক্ত সময় ও পরিবেশেই আদালত এবিষয়ে রুল জারি করেছে।

“যদিও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সব তথ্যই দুদককে সরবরাহ করেছে, তারপরও এবিষয়ে একটি আদেশ থাকা প্রয়োজন। না হয় এরকম একটা অস্বাস্থ্যকর জিনিস হতেই থাকবে। আর আমরা চাপা দিয়ে যাব।”

শুনানিতে মইনুল হোসেন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের চিঠিতে বলা হয়েছে যে তদন্ত করা ‘সমীচীন’ হবে না। দুদককে অনুসন্ধান বা তদন্ত বন্ধ করতে বলা হয়নি। আর এ চিঠির পর দুদক থেমেও থাকেনি। তারা তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। পরবর্তীতে যখন আবার চিঠি দিয়েছে দুদক তখন সুপ্রিম কোর্টও সব তথ্য দিয়েছে। তাই ওই চিঠির আর কার্যকারিতা নেই।

তিনি বলেন, “প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্যই এ চিঠি দিয়েছেন। কোনো ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য নয়।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মইনুল বলেন, “দুদক গত চার-পাঁচ বছর ধরে তাকে (বিচারপতি জয়নুল আবেদীন) হয়রানি করেছে। সম্পদের তথ্য চেয়েছে। তিনি কয়েক দফা সম্পদের তথ্য দিয়েছেন। এরপর গত ৭ বছর দুদক চুপচাপ ছিল। এখন এসে আবার তথ্য চেয়েছে। এর উদ্দেশ্য কী?”

এসময় আদালত এ আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করে, আদালত কাউকে দায়মুক্তি দিতে পারে কি না?

জবাবে মইনুল হোসেন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ওই চিঠিতে তো বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি।

শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলে, যে কোনো একটি রায় হলেই তার সমালোচনা-আলোচনা হচ্ছে। পক্ষে-বিপক্ষে হল কি না, তা দেখা হচ্ছে। রায় পক্ষে গেলে ‘ঐতিহাসিক আর বিপক্ষে গেলে ফরমায়েশি’ হয়ে যাচ্ছে। রায়ের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, ধর্মঘট করা হচ্ছে। বিচারকদের ‘রাস্তায় টেনে’ নিয়ে যাচ্ছে।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, “গত ২৮ মার্চ অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী দুদককে চিঠি দেন, তাতে বলা হয়, ‘নির্দেশিত হয়ে জানানো যাচ্ছে যে….। এরপর অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে অরুণাভ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করে জানতে চান নির্দেশটা কার ছিল?

“এবিষয়ে হাফিজুর রহমানের লেখা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অরুণাভ চক্রবর্তী তাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন যে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে তিনি ওই চিঠি দিয়েছেন।”

আদালত তখন জানতে চায়, সুপ্রিম কোর্ট সব তথ্য দিয়েছে। এরপর কি আর এধরনের চিঠির গুরুত্ব আছে?

জবাবে খুরশীদ আলম বলেন, “এখন প্রশ্ন হল সুপ্রিম কোর্ট দুদককে এ ধরনের চিঠি দিতে পারে কি না?”

দুদক আইনের ১৯(৩) ধারা অনুযায়ী দুদকের কাজে বাধার সৃষ্টি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য ৩ বছর সাজা হতে পারে।

এই আইনটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না- তা দুদকের আইনজীবীর কাছে জানতে চায় আদালত।

খুরশীদ আলম তখন বলেন, “আইনে আছে। তবে দুদক এখনও এ ধারা প্রয়োগ করেনি। এক্ষেত্রে অতদূর যেতে চাচ্ছি না। তবে সুপ্রিম কোর্টের এ চিঠির ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্ত না পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে অন্যরাও সুযোগ নেবে।”